ভূমিকা
উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সম্পদ। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবক্ষেত্রের সাফল্য নির্ভর করে সম্পদের ওপর। ভুখানাঙ্গা, অভুক্ত, অর্ধভুক্ত ও নির্যাতিত জনতার গ্লানি দূর করতে সম্পদের ভূমিকাই মুখ্য। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন। পুঁজিবাদ তথা নিজের উপার্জিত ধন-সম্পদের মালিক নিজেই, এতে অন্য কারো অংশ বা অধিকার নেই, কমিউনিজম অর্থাৎ ধন-সম্পদের যাবতীয় উপায়-উপাদান সমাজের ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত মালিকানা, ব্যক্তির ইচ্ছামত এতে হস্তপেক্ষপ এবং ব্যক্তিগতভাবে এর মুনাফা গ্রহণ করার কোন অধিকার নেই, এ দু’ অর্থব্যবস্থার মুখ থুবড়ে পড়ায় তৃতীয় একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা বর্তমান সমাজের অপরিহার্য দাবী, আর এটিই হচ্ছে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা। The Islamic system is balanced and places everything in its right place.
সম্পদ অর্জন
ইসলামে সম্পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদ ছাড়া সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। এ জন্যেই হালাল রুজির জন্য চেষ্টা চালানোর তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাহিদা পূরণে নিজের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাবে। নিজের, পরিবারের ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা প্রত্যেক মানুষের জন্য কর্তব্য। ইসলাম প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিকে নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য, নিজের পরিবার-পরিজনকে অভাবমুক্ত রাখা ও আল্লাহর পথে ব্যয়ের জন্য জীবিকা উপার্জনের নির্দেশ দান করেছেন। ধন-সম্পদ অর্জনের প্রতি ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। বৈধভাবে সম্পদ অর্জনে ইসলামে কোন বাধা নেই। সৃষ্টি জগতের সবকিছুই মানুষের রুজি রোজগারের জন্য আল্লাহর নেয়ামত থেকে বুদ্ধি ও মেহনতের মাধ্যমে রুজি-রোজগার কামাই করে খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সকলের হক সমান। জীবিকার জন্য যা অপরিহার্য তা সকলের জন্যই সমান। জীবিকার প্রয়োজন হতে বঞ্চিত থাকা ও কাউকে বঞ্চিত করা হারাম। এ পৃথিবী থেকে সম্পদ আহরণ করা, আয় উপার্জন করা এবং এ লক্ষ্যে ব্যবসা-বণিজ্য করা, চাকুরী করা স্বয়ং আল্লাহর ইচ্ছারই বাস্তবায়ন। সালাত শেষ হলে আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকের সন্ধানে-সম্পদ অন্বেষণের বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ রয়েছে। আল্লা তা’আলা বলেন-
فَاِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْاَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ-
যখন সালাত শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে এবং আল্লাহর ফযল (রিযিক) অনুসন্ধান কর।১
وَجَعَلْنَا ايَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُوْا فَضْلًا مِّنْ رَّبِكُمْ-
এবং দিবসের নিদর্শনকে আমি আলোকপ্রদ করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান করতে পার।২ وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا এবং দিন আহরণের সময়করেছি।৩
وَلَقَدْ مَكَّنّكُمْ فِى الْاَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ-
আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠাঁই দিয়েছি এবং তোমাদের জীবিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছি।৪
هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ ذَلُوْلًا فَامْشُوْا فِيْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِه- وَاِلَيْهِ النُّشُوْرُ-
১ আল-কুরআনুল কারীম, সূরা আল-জুমুআ-১০
২ সূরা বনী ইসরাইল-১২
৩ সূরা আন নাবা-১১
৪ সূরা আল আরাফ-১০
তিনিই তোমাদের জন্য যমীনকে কর্ষণযোগ্য করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা তার দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড় এবং তার দেয়া আহার্য গ্রহণ কর। পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট।৫
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوْا فَضْلًا مِّنْ رَّبِّكُمْ-
তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অনুসন্ধানে কোন দোষ নেই।৬ আরোও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-
وَلَا تَؤْتُوا السُّفَهَآءَ اَمْوَالَكُمُ الَّتِيْ جَعَلَ اللهُ لَكُمْ قِيمًا-
তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন তা নির্বোধদের হাতে অর্পণ করো না।৭
وَلَا تَنْسَ نَصِيَْكَ مِنَ الدُّنْيَا
তোমাদের দুনিয়ার অংশের কথা ভুলে যেও না।৮
মহানবী (স.) বলেন-
طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة
প্রতিটি মুসলমানদের জন্য বৈধ জীবিকা উপার্জন ফরয আদায়ের পর বাধ্যতামূলক।৯ তিনি এ বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার জন্য বলেন-
ما كسب الرجل كسبا أطيب من عمل يده
‘কোন ব্যক্তি তার নিজের প্রচেষ্টায় যা উপার্জন করে তার জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না।১০
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার (রা.) নিজের জীবিকা নিজেই উপার্জনে ইসলামী অনুশাসনের প্রতি জোর দিয়েছেন। মানব মর্যাদার একটি অপরিহার্য অনুসিন্ধান্ত হচ্ছে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমেই প্রয়োজন পূরণ করতে হবে, সে অনুসারে ফকীহগণ প্রত্যেক মানুষের তার নিজের পরিবার পরিজনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে উপার্জন করাকে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব (ফরয আইন) আখ্যা দিয়েছে।
اليد العليا خير من اليد السفلى
যে হাত উপরে আছে তা নীচে পেতে রাখা হাতের চেয়ে উত্তম।১১
৫ সূরা আল মুলক-১৫
৬ সূরা আল-বাকারা-১৯৮
৭ সূরা আন নিসা-০৫
৮ সূরা আল কাসাস-৭৭
৯ আল বাইহাকী, আস সুনান আল কুবরা, আল মাকতাবাতুশ শামেলা (২য় এডিশন, খণ্ড-৬), পৃষ্ঠা-৩৫৫।
১০ ৭ঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, আল মাকতাবাতুস আশ শামেলা (২য় এডিশন, খণ্ড-৬), হাদীস নং-২১৩৯, পৃষ্ঠা-৩৫৫।
১১ সহীহ আল বুখারী, আল মাকতাবাতুস আশ শামেলা (২য় এডিশন, খণ্ড-৬), পৃষ্ঠা-২৪৮, নং-১৩৩৮।
সম্পদ অর্জনের উপাদান
সম্পদ অর্জনের উপাদান হচ্ছে ৪টি। যথা- কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও চাকরি। ইসলাম এ চারটি উপাদান কাজে লাগানোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিয়েছে।
১. কৃষি
সৃষ্টিকুলের খাদ্যের যোগান দেয় কৃষি। মহান রাব্বুল আলামীন মানুষের কৃষি কাজের সুবিধার্থে পৃথিবীর মাটি ও ভূমিকে উৎপাদন ও ফসল ফলানোর উপযোগী বানিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَاللهُ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ بِسَاطًا (১৯) لِّتَسْلُكُوْا مِنْهَا سُبُلًا فِجَاجًا (২০)
আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য জমিনকে মেঝে বানিয়ে দিয়েছেন, যেন তোমরা তার উপর অবস্থিত উন্মুক্ত পথে মাঠে চলাচল করতে পার। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র এসেছে-
وَالْاَرْضَ وَضَعَهَا لِلْاَنَامِ (১০) فِيْهَا فَاكِهَةٌ وَّالنَّخْلُ ذَاتُ الْاَكْمَامِ (১১) وَالْحَُّ ذُوْ الْعَصْفِ وَالرَّيْحَانُ (১২) فَبِأَىِّ الَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبنِ (১৩)
জমিনকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি জীবের জন্য বানিয়েছেন, তাতে ফলমুল, খেজুর গাছ যার ফল আবরণ যুক্ত এবং দানাবিশিষ্ট ও সুগন্ধিযুক্ত ফুল রয়েছে। তা হলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? কৃষি জমিকে উৎপাদনের উপযোগী করার নিমিত্ত মহান আল্লাহ বৃষ্টি প্রদান করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
وَهُوَ الَّذِيْ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِه نَبَاتِ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُّخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُّتَرَاكِبًا-
এবং তিনিই আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। পরে তার সাহায্যে সর্বপ্রকার উদ্ভিদ, গাছপালা উৎপাদন করি, পরে তাতে সবুজ শ্যামল তাজা পাতা ও শাখা-প্রশাখা বের করি, তা থেকে ঘনসন্নিবিষ্ট শস্য-দানা উৎপাদন করি। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন-
فَلْيَنْظُرِ الْاِنْسَانُ إِلى طَعَامِه (২৪) اَنَّا صَبَبْنَا الْمَآءَ صَبًّا (২৫) ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ ضَقَّا (২৬) فَاَنْبَتْنَا فِيْهَا حَبًّا (২৭) وَّ عِنَبًا وَّ قَضْبًا (২৮) وَ زَيْتُوْنًا وَّ نَخْلًا (২৯) وَحَدَآئِقَ غُلْبًا (৩০) وَفَاكِهَةً وَّ اَبًّا (৩১) مَّتَاعًا لَّكُمْ وَلِاَنْعَا مِكُمْ (৩২)
মানুষের কর্তব্য তার খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া, চিন্তা করা। আমিই বৃষ্টি বর্ষণ করি, পরে জমি বিস্ময়করভাবে বিদীর্ণ করি। আর তাতে শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, তরি-তরকারী, যয়তুন, খেজুর, বহুবৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদি-খাদ্য উৎপাদন করি, তোমাদের ও তোমাদের পশুর ভোগের জন্য। কৃষি উৎপাদন বাতাস ও বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। কেননা বাতাসের সাহায্যে মেঘমালা চলাচল করে এবং উদ্ভিদসমূহ ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহর ইরশাদ হচ্ছে-
وَالْاَرْضَ مَدَدْنهَا وَاَلْقَيْنَا فِيْهَا رَوَاسِيَ وَاَنْبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَّوْزُوْنٍ (১৯) وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَّسْتُمْ لَه بِرزِقِيْنَ (২০) وَاِنْ مِّنْ شَيْءٍ اِلَّا عِنْدَنَا خَزَآئِنُه وَمَا نُنَزِّلْه اِلَّا بِقَدَرٍ مَّعْلُوْمٍ (২১) وَاَرْسَلْنَا الرِّيحَ لَوَاقِحَ فَاَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَسْقَيْنكُمُوْهُ وَمَا أَنْتُمْ لَه بِخزِنِيْنَ (২২)
পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেকটি জিনিস সুপরিকল্পিত ও পরিমিতভাবে উৎপাদন করেছি। তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি তোমাদের জন্য আর তোমরা যাদের রিযিকদাতা নও, তাদের জন্যও। আমার নিকট আছে প্রত্যেক বস্তুর ভাণ্ডার এবং আমি তা একটা জ্ঞাত পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টি-গর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, পরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই, এই ভাণ্ডার-সঞ্চয় তোমাদের নিকট নেই।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন-
وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِي الْاَرْضِ اِلَّا عَلَى اللهِ رِزْقُهَا-
ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। পবিত্র কুরআনে এ ধরণের বহু আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে যা কিছু এছ সবকিছুর জীবিকার ব্যবস্থা মহান আল্লাহ পাক এই পৃথিবীতেই সৃষ্টি করে রেখেছেন। এ আলো-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, সমভূমি-মরুভূমি সর্বত্র মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট জীবের জীবিকার অসীম উপকরণ রেখে দিয়েছেন- যার অংশ বিশেষও কিয়ামত পর্যন্ত নিঃশোষিত হবে না। আর কালাম-ই পাকের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তার সহজসাধ্যতার উপায়-উপকরণের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যাতে মানুষ তা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আর এ পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আল্লাহ তা’আলার এ নিয়ামত যে ব্যক্তি বা জাতি নিয়মিত ও পরিমিতভাবে আহরণ করতে পারে, সে ব্যক্তি জাতি ততো সমৃদ্ধশালী হবে। শুধু যে সমৃদ্ধশালী হবে তা-ই নয়, এ কাজের জন্য সওয়াব পাওয়া যাবে।
ما من مسلم يغرس غرسا أو يزرع زرعا فياكل منه طير أو إنسان أو بهيمة إلا كان له به صدقة
রাসূল (স.) বলেছেন- যে মুসলমান কোন গাছ লাগায় বা ক্ষেত করে, আর তা থেকে পাখি বা মানুষ যা খায়, তা তার জন্য দান হয়ে যায়।
২. শিল্প
ইসলাম কৃষি কাজের উৎসাহ দিয়েছে। তবে সকলে এ কাজে মগ্ন থাকা ইসলাম পছন্দ করে না। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় বিপদ-আপদের মোকাবেলা কেবল মাত্র কৃষি দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্য কৃষি কাজের সাথে সাথে শিল্প পেশার কাজ করাও জরুরী। এ আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, মাটি-বালি ও তার তলদেশে মহান আল্লাহ তা’আলা যে সম্পদ সৃষ্টি করে রেখেছেন, তার সদ্ব্যবহারের জন্য শিল্পোন্নয়ন জরুরী। শিল্প ক্ষেত্রে বিশেষ সমৃদ্ধি ছাড়া জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা যায় না। শিল্প কর্মের প্রতি পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَعَلَّمْنهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لَّكُمْ لِتُحْصِنَكُمْ مِّنْ بِاْسِكُمْ فَهَلْ اَنْتُمْ شكِرُوْنَ (৮০)
এবং আমরা তাকে বর্ম তৈরী করার শিল্প বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলাম যেন তা যুদ্ধে তোমাদের রক্ষা করে, সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে? হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা তৈরীর বর্ণনা পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে। যা দ্বারা নির্মাণ ও জাহাজ শিল্পের প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত-
وَاَنْزَلْنَا الءحَدِيْدَ فِيْهِ بَاْسٌ شَدِيْدٌ وَمَنَا فِعُ لِلنَّاسِ
এবং আমরা লৌহ সৃষ্টি করেছি, তাতে কঠিন শক্তি নিহিত রয়েছে এবং জনগণের অসীম কল্যাণ।
৩. ব্যবসা
ব্যবসা-বাণিজ্য একটি সম্মানজনক পেশা। জীবিকা অর্জনের এটি একটি অন্যতম উপায়। যাদের আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ রয়েছে তারা এই পেশা অবলম্বন করে, যে জনপদের উপর আল্লাহ তা’আলার রহমত রয়েছে সে জনপদে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
لِاِيْلفِ قُرَيْشٍ (১) الفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَآءِ وَالصَّيْفِ (২) فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هذَا الْبَيْتِ (৩) الَّذِىْ اَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ وَّ امَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ (৪)
যেহেতু কুরাইশরা অভ্যস্ত হয়েছে অর্থাৎ ব্যবসা উপলক্ষ্যে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন বিদেশে সফরে তাদের অভ্যাস রয়েছে, অতএব তাদের কর্তব্য এসবের প্রভু আল্লাহর ইবাদাত করা, যিনি ক্ষুধায় তাদের খাদ্য দিয়েছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। আরো ইরশাদ হচ্ছে-
وَاخَرُوْنَ يَضْرِبُوْنَ فِي الْاَرْضِ يَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاخَرُوْنَ يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ-
কিছু সংখ্যক ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে। এবং অপর কিছু লোক আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে। ব্যবসায়ীরা সাধারণ উদ্ধৃত অঞ্চলের সামগ্রী ঘাটতি অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দিয়ে উদ্ধৃত্ত অঞ্চলের অপচয় রোধ করে এবং ঘাটতি অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করে মানব সমাজের যে সেবা করেছে তা সৎকাজের অন্তর্ভূক্ত। এজন্যই নবী কারীম (সা.) সহ অধিকাংশ নবী-রাসূল এবং হযরত আবু বকর, উসমান, আবদুর রহমান, ইবন আউফ (রা.)-সহ বড় বড় সাহাবী ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন।
এ ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) বলেছেন-
التاجر الصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء-
সত্য পরায়ণ বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গী হবে।
মহানবী (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তিনজনের প্রতি তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র ও করবেন না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন কষ্টদায়ক আজাব। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে, যে মিথ্যা কসম করে তার পণ্য বিক্রয় করে।’ (মুসলিম)
মিথ্যা হচ্ছে সমস্ত পাপের মূল। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে এর প্রচলন সর্বাধিক। পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা অথবা পণ্যের গুণাগুণ বাড়িয়ে বলার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয় এবং কথায় কথায় মিথ্যা কসম খাওয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে ক্রেতাসাধারণ হন ক্ষতিগ্রস্ত। তাই আল্লাহর রাসূল (সা.) ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এই ব্যাপারে উপরোক্ত হাদীসের মাধ্যমে সতর্ক করে দিয়েছেন। ওজন ও পরিমাপে কম-বেশি করাও হারাম।
ইরশাদ হচ্ছে-
وَاَقِيْمُوا الوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَاتُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ-
ওজনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম দিওনা।
মজুদদারী এবং কালোবাজারী পরিহার করে চলতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
من احتكر طعاما أربعين ليلة فقد برئ من الله تعالى وبرئ الله تعالى منه-
যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য ৪০ দিন পর্যন্ত আবদ্ধ রাখে, সে আল্লাহ থেকে মুক্ত, আল্লাহ তা’আলা তার থেকে মুক্ত। অপরদিকে যারা বাজার দরে দ্রব্য বিক্রি করে তাদের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং এটাকে সদকা বা দান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেছেন-
الجالب مرزوق والمحتكر ملعون
যে ব্যক্তি এক স্থান হতে খাদ্যশস্য ক্রয় করে বহন করে নিয়ে অন্য স্থানে তথাকার বাজার দরে বিক্রি করে, সে ব্যক্তি রিযিক প্রাপ্ত, আর গুদামজাতকারী অভিশপ্ত। ইসলামে ব্যবসানীতির মূল কথা হচ্ছে সামাজিক সামষ্টিক কল্যাণ। যে সব পথে উপার্জন বা মুনাফা লাভ করার ক্ষেত্রে অপরের ক্ষতি সাধিত হয়, তা ইসলামে বৈধ নয়। আর সে সব পন্থায় ব্যক্তিদের পরস্পরের মধ্যে লাভ বণ্টন হয় পারস্পরিক সন্তুষ্টি অনুমতির ভিত্তিতে এবং সে বণ্টন হয় সুবিচারপূর্ণ, তা অবশ্যই ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ। শুধু বৈধই নয়, তা ইবাদতও। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لَا تَاْكُلُوْا اَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّا اَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوْا اَنْفُسَكُمْ اِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيْمًا (২৯) وَمَنْ يَّفْعَلْ ذلِكَ عُدْوَانًا وَّ ظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيْهِ نَارًا وَكَانَ ذلِكَ عَلَى الهِ يَسِيْرًا (৩০)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা বাতিল পন্থায় একে অন্যের মাল ভোগ করবে না। তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে যদি ব্যবসা করা হয়, তাহলে তা গ্রহণ করতে পারো। তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। কেননা আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। যে লোক সীমালংঘন ও জুলুমস্বরূপ এ কাজ করবে তাকে আমরা অবশ্য জাহান্নামে পৌঁছে দেবো। এটি আল্লাহর পক্ষে সহজ।
চাকরি
জীবিকা অর্জনের আরেকটি অন্যতম খাত হচ্ছে চাকরি। চাকরির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা ইসলামী আইনে বৈধ। তবে তাকে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ সক্ষম হতে হবে। ইসলামে চাকরি লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে যোগ্যতা অর্জন। যথাযথ যোগ্যতা অর্জন ছাড়া কোন পদের জন্য আবেদন করা ঠিক নয়। হারাম কাজ বা জনগণের ক্ষতিকারক কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এ ক্ষেত্রে হযরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, তিনি বলেন-
عن أبى ذر (رضـ) قال قلت يا رسول الله ألا تستعملني قال فضرب بيده على منكبي ثم قال يا أبا ذر إنك ضعيف وإنها أمانة وإنها يوم القيامة خزي وندامة إلا من أخذها بحقها وأدى الذي عليه فيها-
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিবেন না। একথা শুনে রাসূল (সা.) তাঁর হাত আমার কাধের উপর রেখে বললেন, হে আবু যার! তুমি বড় দূর্বল ব্যক্তি। আর এ পদ হচ্ছে কঠিন আমানতের ব্যাপার। কিয়ামতের দিন তা-ই হবে লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ, তবে যে লোক এ দায়িত্ব যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার সাথে যথাযথ ভাবে পালন করবে তার বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। চাকরির ক্ষেত্রে ইসলামী আইন হচ্ছে উপযুক্ততা ও পরোপকারিতা। দক্ষ চাকরিজীবিগণ স্ব স্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করবে এবং পরোপকারের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে।
সম্পদ অর্জনের বিধান
প্রবন্ধে সম্পদ অর্জনের চারটি উপাদান যথাক্রমে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও চাকরী এ প্রত্যেকটির ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.) সুন্নাহ বিস্তারিত আলোচনা করলে দেখা যায় যে, কিছু বিধান সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে। এগুলো হচ্ছে উপার্জনের হালাল উপায়। Man needs bread to live but he does not live for bread alone.
১. উপার্জন হালাল তথা শরী’আত সম্মত হতে হবে।
২. ব্যক্তি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
৩. বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হতে হবে।
৪. ধৈর্যশীলতা ও পরোপকারিতার মনোভাব থাকতে হবে।
উপার্জনের হারাম উপায়
ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থ-সম্পদ উপার্জনে হালাল-হারাম বিবেচনা করতে হয়। এ অর্থনীতিতে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ বা হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইসলামী শরীআহ নিষিদ্ধ কোন কিছুর স্বত্বার্জনই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বলে গণ্য হয়। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী হারাম অথচ লাভজনক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা অবৈধ ও বেআইনী। অবৈধ বা হারাম উপার্জন মানুষের জীবনকে কলূষিত করে। অন্যায়ভাবে সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ দ্বারা বাহ্যিক প্রাচুর্য ও ভোগ বিলাসের ব্যবস্থা হলেও এর দ্বারা প্রকৃত সুখ ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা যায় না। যারা হারাম বা অবৈধ্য অর্থ-সম্পদের মোহে জীবন ব্যয় করবে তাদের পরকালীন জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। হাদীসে এসেছে মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন-
لا يدخل الجنة لحم نبت من السحت وكل لحم نبت من السحت كانت النار أولى به-
যে দেহ হারাম উপার্জনের খাদ্য দ্বারা গঠিত হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর হারাম খাদ্যে বর্ধিত প্রতিটি গোস্তপিণ্ড জাহান্নামেরই যোগ্য।
এছাড়াও সমাজে অর্থ ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করতে পারে এমন কতকগুলো আয় ও আয়ের পন্থাকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। সুদ, ঘুষ বা উপরি আয় বা বখশিষ বা Invisible cost বা speed money জুয়া, লটারী, ধোঁকা, প্রতারণা, মওজুদদারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, ফটকাবাজারী, চোরাচালান, চটকদার ভুয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রহাকদের সাথে প্রতারণা করা, হারাম পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, ওজন ও পরিমাপে কম দেয়া, মালে ভেজাল মেশানো, ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, বেশ্যাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি অশ্লীলতা প্রসারকারী ব্যবসা, অশ্লীল নাচ-গান, মাদক দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবসা, মূর্তি বানানো ও মূর্তির ব্যবসা, জবরদখল, লুণ্ঠন, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, মাস্তানী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, আত্মসাৎ, চোরাইমাল ক্রয়-বিক্রয়, খেয়ানত, ধাপপাবাজি, সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ইত্যাদি ইসলামে নিষিদ্ধ। এছাড়াও অন্য কোন অসাধু উপায়ে অর্থনৈতিক ভাগ্য গড়ে তোলা যেহেতু অন্যদের ভাগ্যের বিনিময়ে ধনী হওয়ার নামান্তর, সে জন্য ইসলাম সাধারণভঅবে তা নিষিদ্ধ করেছে। Islam strikes at the root of the evil and wants to establish a just and fair society.
সম্পদ ব্যয়ের বিধান
ইসলামে মানব জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা বিবেচিত, এবং এটি প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সম্পদ উপার্জনে নীতিমালা ইসলাম যেমন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তেমনি ব্যয়ের জন্যও রয়ছে সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা। ব্যয়ের কুরআনিক পরিভাষা হচ্ছে ‘ইনফাক’। প্রয়োজন মিটানোর জন্য ব্যয় করাকেই ‘ইনফাক’ বলে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
يَسْاَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلْ مَا اَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فِلِلْوَالِدَيْنِ وَالْاَقْرَبِيْنَ وَالْيَتمى وَالْمَسكِيْنَ وَابْنِ السَّبِيْلِ (২১৫)
লোকেরা আপনাকে কী ব্যয় করবে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করে? আপনি বলুন যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং পথচারী মুসাফিরদের জন্য।
مَثَلُ الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِىْ كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَةٍ وَاللهُ يُضعِفُ لِمَنْ يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ (২৬১)
যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উদাহরণ একটি শস্য বীজ, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যকণা থাকে। আল্লাহ যাকে চান এরূপ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহর প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُوْنَ مَا اَنْفَقُوْا مَنًّا وَلَا اَذًى لَّهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ (২৬২)
যারা আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করে এবং যা ব্যয় করে তার কথা বলে বেড়ায় না ও ক্লেশও দেয় না, তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না।
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْ اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوْ الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِاخِذِيْهِ اِلَّا اَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِ وَاعْلَمُوْا اَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ (২৬৭)
হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি ভূমি থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপাদন করি, তা থেকে যা উৎকৃষ্ট তা দান কর। মন্দ জিনিষ দান করার ইচ্ছা করনা, যেহেতু তোমরা তা গ্রহণ কর না, যদি না তোমরা চক্ষু বন্ধ করে থাকো। এবং জেনে রেখো, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِيَةً فَلَهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَاهُمْ يَحْزَنُوْنَ (২৭৪)
যারা নিজেদের ধন-দৌলত রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের পূণ্য ফল তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তগ্রস্ত হবে না।
وَالَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ رِئَآءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْاخِرِ وَمَنْ يَّكُنِ الشَّيْطنُ لَهُ قَرِيْنًا فَسَآءَ قَرِيْنَا (৩৮)
এবং যারা লোক দেখানোর জন্য তাদের সম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান রাখে না, আল্লাহ তাদের ভালবাসেন না, শয়তান কারো সাথী হলে সে সাথী কতই না মন্দ।
وَلَا يُنْفِقُوْنَ نَفَقَةً صَغِيْرَةً وَّلَا كَبِيْرَةً وَلَا يَقْطَعُوْنَ وَادِيًا اِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللهُ اَحْسَنَ مَا كَانُوْ يَعْمَلُوْنَ (১২১)
এবং ছোট কিংবা বড় যা-ই ব্যয় করে এবং যে কোন প্রান্তরই অতিক্রম করে, তা তাদের অনুকূলে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়, যাতে তারা যা করে আল্লাহ তার চাইতে উৎকৃষ্টতর পুরস্কার তাদের দিতে পারেন।
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ-
এবং যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।
পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে সম্পদ ব্যয়ের নীতিমালা প্রতীয়মান হয়েছ। অর্থ সম্পদ জমা করে রাখাকে ইসলাম পছন্দ করে না। বৈধ পন্থায় লাভের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করাকে মহান রাব্বুল আলামীন পছন্দ করেন এবং উৎসাহিত করেছেন।
বৈধ পন্থায় ব্যয়
উপার্জিত অর্থ বৈধ পন্থায় ব্যয় করা ইবাদত। বৈধ পন্থায় ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে-
১. নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করা।
২. স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতির ভরণ-পোষণের জন্য ব্যয় করা।
৩. পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের জন্য ব্যয় করা।
৪. ফরয, ওয়াজিব ও নফল খাতসমূহে ব্যয় করা।
৫. সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যয় করা। আল্লাহ দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে ব্যয় করা।
৬. অভাবী-দরিদ্রদের জন্য ব্যয় করা।
৭. এরপরও সম্পদ থাকলে এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ইনতিকাল করলে তার সম্পদ ইসলামী মীরাসী আইন অনুযায়ী ভাগ হয়ে যাবে। একজনের মালিকানা তার জীবনকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ তার ইনতিকালের পর সে সম্পদ ইসলামের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তার ওয়ারিশদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
সম্পদ ব্যয়ের নীতিমালা দু’ভাগে ভাগ করা যায়-
১. ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক নীতিমালা।
২. ব্যয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক নীতিমালা।
ইতিবাচক নীতিমালা
১. অল্পে তুষ্টি থাকা, এটি একটি ভাল গুণ। এতে ভোক্তার পছন্দ নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। ভোগ বিলাসকে সে আল্লাহ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা পন্থা হিসেবে গণ্য করে।
২. সহজ সরল জীবন যাপন, এটি ইসলামী শরী’আর একটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সহজ সরল জীবন যাপন মনে আনন্দ দেয়। ঔদ্ধতা, জাঁকজমক, আড়ম্বর ও অনৈতিক জীবন স্টাইল ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূল (সা.) এ ব্যাপারে বলেছেন- তোমাদের বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা প্রদানের জন্য আল্লাহ আমাকে অহীর মধ্যমে অবগত করেছেন, যাতে অন্যের প্রতি কোন অন্যায় করতে না পারে এবং দাম্ভিকতা প্রকাশ করতে না পারে।
৩. মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা, ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক নীতিমালা
১. ইসরাফ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাকেই ইসরাফ বলে। ইসরাফ অর্থ সীমা অতিক্রম করা, অপচয় করা। মানুষ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অনেক কিছুই অপচয় করছে। কাজ না করে সময়ের অপচয় করছে, জিনিসপত্রের সঠিক ব্যবহার না করে অপচয় করছে। পানাহারে বা ভোগবিলাসে অতিরিক্ত ব্যয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থবাদী ভোগবাদী জীবনধারার অনুসরণ ফুটে উঠে।
২. সামাজিক পর্যায়ে ইসরাফ সংক্রান্ত নীতি আরো ব্যাপকভঅবে অনুসূত হবে। সরকারের পরিকল্পনা, আমদানী-রফতানী, উৎপাদন, বণ্টননীতি এমনভাবে তৈরী হতে হবে, যাতে সে সময়ের প্রেক্ষিতে সে দেশে ‘ইসরাফ’ উৎসাহিত না হয় এবং ব্যক্তিপর্যায়ে ইসরাফ করার সুযোগ কমে যায়। সরকার নিজেও ইসরাফ পরিহার করবে। ব্যয়ের ইসলামী নীতিতে তাই আদর্শ ও কাম্য।
৩. তাবজীর অপব্যয়ঃ হালাল সম্পদ হারাম কাজ, অশ্লীল, ইসলামে রক্ষতি সাধনে ব্যয় করা। কোন বস্তুকে তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ব্যয় না করে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করলে, হারাম খঅতে ব্যয় করলে, অপব্যবহার করলে, সেটাকে বলা হয় তাবজীর। ইসরাফের তুলনায় তাবজীরের ক্ষতি ব্যাপক।
اِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَكَانُوْا اِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ-
এজন্য তাবজীরকারীদের শয়তানের ভাই বলা হয়েছে।
৪. অবৈধ উপার্জন হতে অবৈধ খাতে ব্যয়েই শুধু নিষিদ্ধ নয়, হালাল উপার্জন হতেও অবৈধ খাতে ব্যয় নিষিদ্ধ। এজন্যই ইসলামে তাবজীরকারী বা অপ্যয়কারীকে পছন্দ করা হয় না। অপব্যয়ের ছিদ্রপথেই সংসারে আসে অভাব অনটন। সমাজে আসে অশান্তি। রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয় বিপর্যয়। এজন্য অপব্যয় বা তাবজীর ইসলামে অপরাধ।
৫. বুখল বা কৃপণতা: সম্পদ ব্যয় ও ব্যবহার না কর। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতা অবলম্বন করা অত্যন্ত দূষণীয়। কৃপণতা মানুষের একটি মন্দ স্বভাব। ইসলামী জীবন বিধানে কৃপণতার কোন স্থান নেই। কৃপণতা ব্যক্তি ও সমাজের জন্যে কখনও কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা সমাজে ক্ষতিই করে থাকে।
ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা
যাকাত একটি ফরয ইবাদত, যাকাত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। সঞ্চিত টাকা, সঞ্চিত মূল্যবান দ্রব্য-সামগ্রী, শস্য সোন, রূপা, গবাদিপশু, যেমন- গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা প্রভৃতি নেসাব অনুযায়ী এক বছর যাবত অপরিবর্তনীয় থাকলে তার ২.৫% যাকাত হিসেবে প্রদান করতে হয়। নিচে যাকাতে হারসমূহ প্রদত্ত হলো-
ক. সঞ্চিত টাকার যাকাত, প্রতি ১০০ টাকায় ২.৫০ টাকা হিসেবে যাকাত দিতে হয়।
ক. সোনার যাকাত, যদি ৭.৫০ (সাড়ে সাত) তোলা সোনা বছর যাবত কারো মালিকানাধীন থাকে, তবে তাকে শতকরা ২.৫০ হিসেবে যাকাত দিতে হবে।
গ. রূপার যাকাত, যদি কারো মালিকানাধীনে ৫২.৫০ (সাড়ে বায়ান্ন) তোলা রূপা এক বছর যাবত থাকে তখন তাকে নির্ধারিত পরিমাণ যাকাত দিতে হয়।
ঘ. উশর, জমিতে উৎপাদিত ফসল ১০% যাকাত হিসেবে প্রদান করাকে ওশর বলে। এভাবে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গবাদি পশুরও যাকাত দিতে হয়। তবে যে জমিতে সেচ পদ্ধতিতে চাষ করা হয় হয় উহার ৫% যাকাত দিতে হবে।
যাকাত হিসেবে আদায়কৃত অর্থ সরকারের সাধারণ তহবিলে নেয়া যায় না। যাকাত তহবিল নামে একটি বিশেষ তহবিলে এ অর্থ জমা করা হয়। এটি একটি বাধ্যতামূলক তহবিল যার আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যাকাত প্রদানকারী রাষ্ট্রীয় যাকাত তহবিলে যাকাতের অর্থ জমা দেবে আর ইসলামী রাষ্ট্র সে অর্থ ব্যয় করবে।
وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاتُوا الزَّكَاةَ-
‘নামায কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর’। এ আয়াতে ব্যক্তিকে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল, কেউ যদি যাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জানায়, ইসলামী রাষ্ট্র সেক্ষেত্রে জোরপূর্বক তা আদায় করে নেবে। রাসূল (স.)-এর ওফাতের পর কয়েকটি গোষ্ঠী যাকাত দিতে অস্বীকার করে। হযরত আবু বকর (রা.) তাদের কাছে হুশিয়ারী বাণী পাঠিয়ে বলেন, যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানানো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল এবং তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকর। যাকাতের মাধ্যমে দরিদ্র্য, অক্ষম ও অভাবগ্রস্ত লোকদের পূর্ণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করা যায়। কেননা-
Zakah channels wealth from the rich to the poor while interest takes away wealth from the poor and hands it over to the rich.
যাকাত ব্যবস্থা বাংলাদেশে কতটুকু কার্যকর
যাকাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল উন্নয়নের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাতি তা থেকে বঞ্চিত। কারণ, যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বাধা। যেমন-
১. বাংলাদেশে ইসলামের মৌলিক যে সব প্রসঙ্গ নিয়ে জোরদার আলোচনা কম হয়েছে যাকাত সে সবের অন্যতম। যাকাত সম্বন্ধে পত্র পত্রিকায় যদিও কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে তবে তা যৎসমান্যই। আলেম সমাজ যদি জনগণকে যাকাতের হাকীকত ও ফযীলত সম্পর্কে যথাযথ বক্তব্য রাখতেন তবে এতদিনে যাকাতের উপযুক্ত ব্যবহার ও আদায় সম্পর্কে আরো বেশি সচেতনতা লক্ষ্য করা যেত। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও ব্যবহার হলে যে কল্যাণ ও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যেতো সে বিষয়েও জনগণের কোন ধারণা নেই।
২. সাহেবে নেসাবদের থেকে যাকাত আদায় করার জন্য এদেশে কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। প্রয়োজনীয় আইন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যো গৃহীত না হওয়াই এজন্য প্রধানতঃ দায়ী।
৩. যারা যাকাত দিয়ে থাকেন তারা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, ইয়াতিমখানায় ও ফকির মিসকিনকে তাদের যাকাত পৌঁছে দেন। বিপুল সংখ্যক যাকাত প্রদানকারী পুরুষ ও মহিলা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মর্জি মাফিক তাদের প্রদেয় যাকাতে অর্থ বিলিবন্টন করে থাকেন। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন খুব সহজসাধ্য নয়।
৪. সরকার যদি এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করে তবুও জনগণের পক্ষ থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া পাওয়া খুব সহজ হবে না। কারণ এদেশের সরকারের আর্থিক লেন-দেন ও অর্থব্যয়ের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের আচরণ ব্যক্তি জীবন ও ইসলামের প্রতি দৃঢ়তার ব্যাপারে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, তাদের পর্যবেক্ষণ করবে। উপরিউক্ত সমস্যাবলির কারণে বাংলাদেশে যাকাত ব্যবস্থা তেমন কার্যকর নেই বললেই চলে। তবে যাকাত ব্যবস্থার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারেরও তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সরকারী কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া যাকাত ব্যবস্থার উন্নতি আশা করা যায় না।
যাকাত বন্টনের খাতসমূহ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শুধু যাকাত আদায় করার জন্য তাকিদ প্রদান করেননি বরং যাকাতের অর্থ বন্টনের খাতগুলোও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
اِنَّمَا الصَّدَقتُ لِلْفُقَرَآءِ وَالْمَسكِيْنَ وَالْمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْزُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ-
যাকাত হলো কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। উপরিউক্ত আয়াতে যাকাত ব্যয়ের মোট আটটি খাতে কথা বলা হয়েছে।
১. ফকীর ঃ যাদের অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন দুঃখ কষ্টে অতিবাহিত হয়, লোকলজ্জায় কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে না তাদেরকে ফকীর বলে। যাকাত দিয়ে দরিদ্র, অভাবী, ফকীর শ্রেণীর, পূণর্বাসন, বেকারত্ব দূর করে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা একান্ত কর্তব্য। রাসূল (স.) বলেন- যাকাত মুসলিম সমাজের ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
২. মিসকীন ঃ মিসকীন বলতে দৈহিক অক্ষম ব্যক্তিদের বুঝায়। যেমন- অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পঙ্গু, মানসিক প্রতবিন্ধী ইত্যাদি শ্রেণীকে মিসকীন বলা হয়।
৩. যাকাত আদায়কারী কর্মচারী ঃ যারা যাকাত আদায় ও বন্টন করে এবং এ সকল কাজে নিয়োজিত, তাদের বেতন-ভাতা হিসেবে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে।
৪. নও মুসলিমদের সংরক্ষণ ও মন আকৃষ্ট করা ঃ যাকাতের পরবর্তী ব্যয় খাত হিসেবে নও মুসলিমদের মন আকৃষ্ট করার কথা বলা হয়েছে।
৫. দাসত্ব মোচন ঃ যদি কোন ব্যক্তি কোন কারণে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে কোন ভাবে জিম্মি বা বন্দী হয়, তবে তার মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ থেকে ব্যয় করা যায়।
৬. আল্লাহর পথে (ফী সাবিলিল্লাহ) ঃ এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ এবং এর ব্যাখ্যাও বিস্তৃত। সাধারণভাবে এটা জিহাদের অর্থ বুঝায়। আল-কুরআনুল কারীমে যত স্থানে জিহাদের কথা এসেছে সবখানে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হয়েছে। তবে আভিধানিক অর্থে একে জিহাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে বরং সকল প্রকার কল্যাণময় ও নেক কাজকে এর মধ্যে শামিল করা হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা এবং যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত আছে সেখানে একে কায়েম রাখার জন্য যেসব বিশাল কাজের আঞ্জাম দিতে হয় সেজন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
অন্যদিকে ইসলামী রাষ্ট্র ও আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে সংগঠিত দল ও সংগঠন জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর মর্যাদা পেতে পারে যদি তাদের নীতি, আদর্শ, কর্মপন্থা ও উদ্দেশ্য হয় একমাত্র আল্লাহর যমীনে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম ও দ্বীনের কালেমাকে সমুন্নতকরণ। এক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা বা যুদ্ধ প্রতিরোধ করার চেয়ে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরিবেশ থেকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে দাওয়াতের কাজটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দাওয়াতের কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় একটি বড় ব্যয় ক্ষেত্র। মূলত : জীবন ঘনিষ্ঠ ইসলামী সাহিত্য রচনা, মাহফিল পরিচালনা ও বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজ আঞ্জাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থের যোগান যাকাতের এ খাত থেকে হতে পারে। এমনকি পাশ্চাত্য কর্তৃক পরিচালিত তরুণদের চরিত্র ধ্বংসকারী ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপরীতে আদর্শবাদী ধ্যান-ধারণার পরিচালিত ইলেকট্রনিক মিডিয়া গঠন করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বাণী ও কথা প্রচারে কাজে প্রয়োজনে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
৮. মুসাফির ঃ যাকাত ব্যয়ের সর্বশেষ খাত হচ্ছে ‘মুসাফির’ কুরআনের ভাষায় “ابن السبيل” এর অর্থ হচ্ছে পথে চলমান ব্যক্তি। ভ্রমণকারী বা পর্যটক। যে ব্যক্তি নিজবাড়ী থেকে বেরিয়ে অন্য এক শহরে বা দেশে প্রবেশ করেছে যেখানে তার কোন সহায় সম্বল নেই। নিজের দেশে তার অনেক সম্পদ থাকলেও ব্যবহার করতে পারছেনা, তাকেই ‘ইবনুস সাবীল’ বা মুসাফির হিসেবে গণ্য করা হয়। সফরকালীন সময়ে তার রসদপত্র, খরচ নিঃশেষ হয়ে গেল এবং তা সংগ্রহের কোন ব্যবস্থা না থাকলে যে যাকাত গ্রহণ করতে পারে। তবে সবকটি শরী’আ অনুমোদিত হবে।
যাকাত আদায় বৃদ্ধি করার কৌশল
আমার মতে, নিচের সুপারিশমালার ভিত্তিতে যাকাত আদায় বৃদ্ধি করা যায়।
১. কোন ব্যক্তি যাকাত প্রদানে অস্বীকার করলে তবে আইনের আওতায় এনে তার কাছ থেকে যাকাত আদায় করতে হবে।
২. রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত তহবিল এবং প্রয়োজনীয় আইন থাকবে।
৩. যাকাত ঐচ্ছিক বিষয় নয়, একে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. প্রত্যেক মুসলমান যিনি ‘মালিকে নেসাব’ তাকে অবশ্যই যাকাত প্রদান করতে হবে।
৫. মালিকে নেসাব ব্যক্তিদের প্রতি বছর তালিকা তৈরী করা।
৬. যাকাত বন্টনের কাজটি ইসলামী রাষ্ট্র সমাধা করবে, ব্যক্তি নয়।
৭. মালিকে নেসাব নিজে হিসাব করে তার দেয়া যাকাতের অর্থ সরকারী যাকাত তহবিলে জমা দেবে।
৮. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত যাকাত প্রাপ্যদের ৮টি শ্রেণীর মধ্যে সরকার তা বন্টন করবে।
৯. ব্যাংকে জমাকৃত টাকায় যাকাত ব্যাংক থেকেই সংগ্রহ করার আইন কার্যকর করতে হবে।
১০. ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে একথা বোঝাতে হবে যে, যাকাত করুণা নয়, বরং এটা সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য অবশ্য দেয় বিষয়।
১১. বেসরকারী বিশ্বস্থ সংস্থাকে দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করা।
সম্পদ অর্জন ও ব্যয় সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনে আয়াতসমূহের বিবরণ ঃ
সূরা নং ও নাম আয়াত নাম্বার মোট
০২. আল-বাকারা ১৬৮,১৮৮,২৪৫,২৭৫,২৭৮,২৭৯,২৮০,২৮৩ ০৮
০৩. আল-ইমরান ১৬১, ১৮০ ০২
০৪. আল-নেছা ০৫,০৬,০৭,১০,১১,১২,২৯,৩৬,১৭৬ ১০
০৫. আল-মায়েদা ৩৮,৫৫,৮৮ ০৩
০৬. আল-আনআম ১৪১,১৪৫,১৬৫ ০৩
০৭. আল-আ’রাফ ১০,৩১,৩২ ০৩
০৮ আল-আনফাল ০২,০৩,০৪ ০৩
০৯. আত-তাওবা ৩৪,৬০,১০৩ ০৩
১১. হুদ ৮৭ ০১
১৬. আন-নাহল ৭১,১১৪,১১৫,১১৬ ০৪
১৭. আল-ইসরা ২৬,২৭ ০২
২৪. আন নূর ১৯,২৩,২৭,৩৭ ০৪
২৫. আল-ফোরকান ৬৭ ০১
২৮. আল-কাসাস ৫৮,৭৭ ০২
৩১. লুকমান ২০ ০১
৩৪. সাবা ৩৪,৩৫ ০২
৩৬. ইয়াসীন ৭১ ০১
৪২. আশ-শুরা ১২ ০১
৫১. আয-যারিয়াত ১৯ ০১
৫৭. আল-হাদীদ ২৭ ০১
৬১. আস-সাফ ১১ ০১
৬২. আল-জুমুআ ০৯ ০১
৬৭. আল-মূলক ১৫ ০১
৭০. আল-মা’আরেফ ২৪,২৫ ০২
৭৩. আল মুয্যাম্মিল ২০ ০১
৭৬. আল-ইনসান ০৮,০৯ ০২
৮৩. আল-মুতাফফীন ০১,০২,০৩ ০৩
৯৯. আয-যিলযাল ০৫ ০১
১০২. আত-তাকাছুর ০১,০২,০৩ ০৩
১০৪. আল-হুমাযাহ ০১,০২,০৩,০৪ ০৪
মোট আয়াত সংখ্যা ৭৯
উপসংহার
মহান রাব্বুল আলামীন মানুষের উভয় পর্যায়ের কল্যাণ কামনা করার শিক্ষা দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে এসেছে-
رَبَّنَا اتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِى الْاخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ-
হে আমাদের রব! আমাদের কে দুনিয়ার কল্যাণ দিন এবং আখেরাতের কল্যাণ দিন। আর আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান।
দুনিয়ার কল্যাণের জন্য অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন। পরকালের জন্যও এর অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামে সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। হালাল রুজির জন্য চেষ্টা চালানোর তাগীদ দিয়েছে ইসলাম। নিজের পরিবার ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালানো প্রত্যেক ব্যক্তি জন্যই কর্তব্য।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও কমিউনিজিম অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত হচ্ছে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা যা সার্বজনীন ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার সুফল সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার প্রতিফল হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে যদি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা চালু করার উদ্যেগ নেয়া হয়, তা হলে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা বলতে কিছুই থাকবে না। কারণ আল্লাহ কোন প্রাণী সৃষ্টি করার পূর্বেই তার রিযিকের ব্যবস্থা করে থাকেন।
আল্লাহ বলেন-
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِى الْاَرْضِ اِلَّا عَلَى اللهِ رِزْقُهَا-
প্রত্যেক প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর। এ ছাড়া প্রত্যেক ঈমানদারের অর্থ ব্যবস্থা অবশ্য ইসলামী আইনের আওতায় হবে। কেননা অর্থ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ পার্থিব জগতে পেশ করার সাথে সাথে পরকালে আল্লাহ তা’আলার দরবারে হিসাব দেয়া ছাড়া এক কদম অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। শরী’আহ মোতাবেক সম্পদ অর্জন ও ব্যয় ইবাদত। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ মহান এবাদত পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!