ভূমিকা
আল-কুরআন মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে রাসূল সা. এর উপর নাযিল করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাই এ গ্রন্থের হিফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই এতে কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের অবকাশ নেই। আল-কুরআন যেমনটি নাযিল হয়েছিল তেমনটিই রয়েছে এবং চিরকালই আপন অবস্থায় থাকবে। এর একটি শব্দ বা বর্ণও রদবদল হয়নি এবং কখনো হবে না। অসংখ্য হাফিযের হৃদয়ে পূর্ণ আল-কুরআন সংরক্ষিত আছে। এটিও আল-কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম মু’জিযা। অন্য কোন আসমানী গ্রন্থ এভাবে সংরক্ষিত নেই। আল-কুরআনই অপরিবর্তিত ধর্মগ্রন্থরূপে চিরকাল বলবৎ থাকবে। এর মধ্যে বিধৃত আদর্শ, নীতি ও আইন-কানুন সর্ব কালের সকল দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এছাড়া মানুষ ও জ্বিন জাতির হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ নাযিলকৃত গ্রন্থ হচ্ছে আল-কুরআন। পবিত্র কুরআনে এসেছে- “যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং মুহাম্মদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করে, আর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এ নাযিলকৃত আল-কুরআন সত্য।” তিনি তাদের মন্দ কাজগুলো বিদূরিত করবেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করবেন।” ১ (সূরা মুহাম্মদ, ১৬: ২)
এ আয়াতে ‘আয যিকর’ বলে আল-কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- আমি এ আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পার। ৩ (সূরা ইউসুফ, ১২: ২)
মহান রাব্বুল আলামীন লাওহে মাহফুয থেকে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি তেইশ বছরের নবুওয়াতকালে এ কিতাব নাযিল করেছেন।
আল কুরআনের মূল বিষয়বস্তু হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (র) এর মতে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়-
১. ইলমুল আহকাম: ইবাদাত, মু’আমালাত, লেন-দেন, মু’আশারাত সামাজিকতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ওয়াজিব-অবশ্যকরণীয়, মান্দুব-প্রশংসনীয়, মুবাহ-বৈধ, মাকরূহ-অপছন্দনীয় এবং হারাম অবশ্য পরিত্যাজ্য ইত্যাদি বিষয়াদি সম্পর্কিত তথ্য জ্ঞান।
২. ইলমুল মুখাসামা: অর্থাৎ ইয়াহুদী, খৃষ্টান, মুশরিক ও মুনাফিক এই চারটি দলের সাথে বিতর্কে পারদর্শিতা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম তথা জ্ঞান।
৩. ইলমুত তাযকীর বি আলাইল্লাহ: আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ও নিদর্শন সম্পর্কিত ইলম। এতে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য, আল্লাহ প্রদত্ত ইলহাম এবং সৃষ্টিকর্তার সর্ববিধ গুণাবলীর পরিচয় সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে।
৪. ইলমুত তাযকীর বি আইয়ামিল্লাহ: আল্লাহ তা’আলার সৃষ্ট বস্তুর অবস্থা, অনুগতদের পুরস্কার ও অবাধ্যদের শাস্তি সম্পর্কিত বর্ণনা।
৫. ইলমুত তাযকীর বিলমাউত ওয়া মা বা’দাল মাউত: অর্থাৎ মৃত্যু ও তার পরবর্তী কালে অবস্থা সম্পর্কিত ইলম তথা জ্ঞান। এতে পুনরুত্থান, একত্রীকরণ, হিসাব নিকাশ, মিযান ও জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কিত বর্ণনা সমূহ বিদ্যমান রয়েছে। এচাড়া মাক্কী সূরাসমূহে তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্না, হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে এবং মাদানী সূরা সমূহে শরীআতের হুকুম আহকাম তথা আচার-ব্যবহার, হালাল-হারাম, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আল-কুরআনের জ্ঞান অর্জনের মর্যাদা ও গুরুত্ব
মানুষ কার আনুগত্য করবে, কীভাবে আনুগত্য করবে এবং কি কি কাজ থেকে বিরত থাকবে তা জানার জন্যে আলকুরআনের ইলম বা জ্ঞানের প্রয়োজন। এ জন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবুওয়াতের সূচনাতেই সর্বপ্রথম যে আয়াতসমূহ হেরা গুহায় নাযিল করেন তাতে জ্ঞান অর্জন অত্যাবশ্যক করে নির্দেশ ‘পড়’। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اقرأ باسم ربك الذي خلق -পাঠ করুণ আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
خلق الإنسان من علق – সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।
اقرأ وربك الأكرم – পাঠ করুণ, আর আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত।
الذى علم بالقلم – যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা নিয়েছেন।
علم الانسان مالم يعلم – শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। ৪ (সূরা আলাক, ৯৬: ১-৫)
এ আয়াতসমূহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে-
ক. মহান স্রষ্টার সর্বপ্রথম নির্দেশ হচ্ছে Òاقرأ” পড়বা অধ্যয়ন কর।
খ. ‘জমাট রক্তের’ মত সাধারণ ও তুচ্ছ বস্তু থেকে মহিনান্বিত প্রতিপালক এর সান্নিধ্যে ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে জ্ঞানসাধনাকে সেতুবন্ধন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গ. কলম-এর সাহায্যে তিনি মানব জাতিকে জ্ঞানদান করেছেন।
এ প্রথম প্রত্যাদেশ থেকেই জ্ঞান অর্জনের মর্যাদা ও গুরুত্ব সুষ্পষ্ট।
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- قل هل يستوى الذين يعلمنو والذين لايعلمون – বলুন, যার জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? ৫ (সূরা যুমার, ৩৯: ০৯) অন্য আয়াতে উল্লেখ রয়েছে يرفع الله الذين امنوا منكم والذين اوتوا العلم درجت – তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। ৬ (সূরা মুজাদালা, ৫৮: ১১)
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- يؤتى الحكمة من يشاء ومن يؤت الحكمة فقد اوتي خير اكثيرا – তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত প্রদান করেন এবং যাকে হিকমত প্রদান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। ৭ (সূরা বাকারা, ২: ২৬৯)
রাসূলুল্লাহ (সা.) কে কিতাব ও হিকমত দানের মাধ্যমে তাঁকে যে মহান মর্যাদা দান করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন– وانزل الله عليك الكتب والحكمة وعلمك مالم تكن تعلم – আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। ৮ (সূরা নিসা, ৪: ১১৩)
রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীসে এভাবে এসেছে- من يرد الله به خيرا يفقهه فى الدين وإنما أنا قاسم والله يعطي – আল্লাহ যার মঙ্গল কামনা করেন তাকে দীনের ব্যুৎপত্তি দান করেন। বস্তুত আমি বণ্টনকারী এবং দাতা হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। ৯ (বুখারী ও মুসলিম. সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৩২)
মানব জাতির চরম উৎকর্ষ সাধনকারী জ্ঞান। প্রতিটি মুসলমানের জন্যে জ্ঞানার্জনকে ফরয হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন طلب العلم فريضة على كل مسلم – ইলম তথা জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফলয। ১০ (ইবন মাজা. সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৩৪)
আল-কুরআনের জ্ঞান অর্জনে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি
আল্লাহ তা’আলার প্রিয়পাত্র হতে হলে অবশ্যই ইলম অর্জন করে তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয় সমূহ জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর এ উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি জ্ঞানান্বেষণে রত থাকে, আল্লাহ তা’আলার কাছে তার মর্যাদা সম্পর্কে হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন- আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম অন্বষণের লক্ষ্যে পথ চলে আল্লাহ তা’আলা তার জন্যে জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। জ্ঞান অর্জনকারীর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরিশতাগণ তাঁদের ডানা তাঁদের জন্য বিছিয়ে দেন। আর ইসলামী জ্ঞান অর্জনকারীর জন্যে আসমান যমীনের সবকিছু ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমন কি পানির মাছও। নিছক ইবাদতকারী ব্যক্তির তুলনায় বিজ্ঞ আলিমের মর্যাদা ঠিক সেরূপ যেমনটি পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা সমস্ত তারকার তুলনায়। আলিমগণ হচ্ছেন, নবীগণের ওয়ারিশ ও উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ কাউকে দীনার ও দিরহামের উত্তোরাধিকারী করে যাননি। তাঁরা উত্তরাধিকারী কনের ইলমের। যে ব্যক্তি তা অর্জন করল সে প্রচুর কল্যাণ লাভ করল। (আবু দাউদ ও তিরমিযী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৩৪)।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে-
أفضل الأعمال العلم لله ان العلم ينفعك معه قليل العمل وكثيره و ان الجهل لاينفعك معه قليل العمل ولا كثيره-
সর্বোত্তম আমল হচ্ছে আল্লাহ বিষয়ক ইলম। নিঃসন্দেহে ইলম তোমার উপকারে আসবে, চাই তার সঙ্গে অল্প আমল হোক, বা অধিক আমল হোক আর অজ্ঞতা তোমার কোনও উপকারে আসবে না, চাই তার সাথে অল্প আমলই থাক বা অধিক আমলই থাক। ১১ (কানযুল হাকাইক ফী হাদীসি খায়রিল খালাইক, জামি’ সগীরের পাদটিকা)
আল-কুরআন বুঝার গুরুত্ব
আল-কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য হল, মানব সভ্যতার উৎকর্ষ বিধান, বাতিল ও ভ্রান্ত আকীদার মূলোৎপাটন এবং কুসংস্কার ও কুকার্যসমূহ খতম করে আদর্শের ভিত্তিতে ব্যক্তি ও সমাজ গঠন করা। নাযিলের এ মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন নির্ভর করে আল-কুরআনের সঠিক মর্যাদা বুঝার উপর। নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হল-
আল-কুরআন সর্বপ্রকার জ্ঞানের উৎস এবং মুল ভিত্তি: আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এর বিধান অনুযায়ী আমল তথা বাস্তবায়ন করার জন্য। বাস্তবায়নের জন্য বুঝা ও উপলব্ধির প্রয়োজন। না বুঝে আমল বা বাস্তবায়ন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি আল-কুরআন পড়ে অথচ বোঝে না তার উদাহরণ হল- যেমন একদল লোকের কাছে তাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি নির্দেশিকা এলো, যাতে লিখা আছে কি কা যাবে, আর কি করা যাবে না; কিসে তাদের মঙ্গল হবে এবং কিভাবে চললে শত্রু তাদেরকে পাকড়াও করবে। তারা সে নির্দেশিকা মাথায় রেখে খুবই সম্মান দেখাল এবং সুন্দর সুরে তা পড়ল কিন্তু বুঝার চেষ্টা না করে ভুল পথে চলল, ফলে অনিবার্যরূপেই তারা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করল দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সর্ব প্রকার কল্যাণ এর মাধ্যমেই শুধু অর্জিত হয়।
দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও ধারণা আল-কুরআনের অর্থ বুঝার উপর নির্ভর করে: এ প্রসঙ্গে আবুদারদা রা. বলেন, “আমরা রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম, তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “এটা সে সময় যখন মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে, ফলে তারা তা অর্জন করতে সক্ষম হবে না।” তখন যিয়াদ ইবন লাবিদ আল-আনসারী রা. বললেন, কিভাবে জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে অথচ আমরা আল-কুরআন পড়েছি, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই আল-কুরআন পড়ব, আর আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে কুরআন পড়াব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে যিহাদ, তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। (তোমার মৃত্যু হোক) (এটা কোন বদদোয়া নয়, বরং আরবী বাকরীতি। অপছন্দনীয় কিংবা সঠিক নয় এমন কথা বলা হলে আরবগণ এ বাক্য কিংবা ‘ওয়াইলাক’ (তোমার ধ্বংস) ব্যবহার করে থাকে।) আমি তো তোমাকে মদীনাবাসী ফকীহদের মধ্যে গণ্য করতাম। তাওরাত এবং ইনজিল ইয়াহুদ ও নাসারাদের কাছে আছে। কিন্তু তা তাদের কি কাজে এসেছে? জুবায়ের বললেন, এরপর আমরা উবাদাহ ইবন আস-সামিত (রা.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, তুমি কি শুনেছ তোমার ভাই আবুদারদা কি বলেছে? আমি আবুদ্দারদা কি বলেছে তা তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আবুদ্দারদা সত্য বলেছে, তুমি চাইলে আমি তোমার কাছে সে ইলম সম্পর্কে বলব যা সর্বপ্রথম উঠিয়ে নেয়া হবে, তা হল খুশু ও বিনয়। তুমি হয়ত কোন মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে কোন বিনয়ী লোক পাবে না। ১২ (সুনান তিরমিযী, কিতাবুল ইলম, বাব: ইলম উঠে যাওয়া প্রসঙ্গে যা এসেছে, হাদীস নং ২৬৫৩, তিরমিযী বলেন, ‘এটি হাসান গরীব হাদীস’। আলবানী বলেন, ‘সহীহ’।) অতএব, বুঝা গেল যে, ইলম ও জ্ঞান উঠে যাওয়ার কারণই হল এমন ব্যক্তিগনের অভাব ও অনুপস্থিতি, যারা ইলমকে ধারণ করবেন এবং সঠিকভাবে উপলব্ধি করবেন ও আমল করবেন।
আল-কুরআনের জ্ঞানার্জনে অধিক সওয়াব
আল-কুরআন বুঝা ও কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণার অনেক সাওয়াব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উকবা ইবন আমের আল-জুহানী (রা.) বলেন,
“আমরা আহলে সুফফার সাথে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাদের কাছে এসে বললেন, “তোমাদের কোন ব্যক্তির এটা পছন্দ যে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়াই এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করে বুতহান অথবা আকীক প্রান্তরে (মদীনার দু’টো উপত্যকা) গিয়ে দু’টো বিশালকায় উট নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, আমাদের সবারই তা পছন্দ। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে কিতাবুল্লার দু’টো আয়াত শেখা কিংবা পড়া দুটি উটের চেয়েও তার জন্য উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে এবং চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। আর যতগুলো আয়াত সে অধ্যয়ন করবে তা সমসংখ্যক উটের চেয়ে উত্তম। ১৩ (সহীহ মুসলিম, কিতাব: মুসাফিরদের সালাত ও এর কসর, বাব: কুরআন শেখা ও সালাতের মধ্যে কুরআন অধ্যয়নের ফযীলত, হাদীস নং ১৯০৯)
যদি জ্ঞানার্জন সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাকর কাজ হয়ে থাকে তাহলে এর অগ্রভাগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আল্লাহর কালাম জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করা। কেননা জ্ঞানের মর্যাদা জ্ঞানগত বিষয়ের মর্যাদার উপর নির্ভর করে। কিতাবুল্লাহ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে সম্মানিত বিষয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলার এ বাণী অধ্যয়ন করা সবচেয়ে বেশি সওয়াবের কাজ।
সম্প্রীতি ও হৃদ্যতা সৃষ্টিতে আল-কুরআন
সম্প্রীতি ও হৃদ্যতা আনয়নের বিশুদ্ধ গ্রন্থ আল-কুরআন। মুসলমানদের অনৈক্য, ভুল বুঝাবুঝি ও হানাহানি দূর করে ভালবাসা, সম্প্রীতি ও হৃদ্যতা আনয়নের বিশুদ্ধ উপকরণই হল আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝা ও হৃদয়ঙ্গম করা। কুরআনকে সঠিকভাবে না বুঝাই হল যত অনৈক্যের মূল। ইবরাহীম আত-তাইমী বলেন, ‘হযরত ওমর (রা.) একদিন একাকী ছিলেন, তিনি স্বগতোক্তি করে বললেন, কিভাবে এ উম্মতের মধ্যে বিভেধ থাকতে পারে, অথচ তাদের নবী এক এবং কিবলা এক। এরপর তিনি ইবনে আব্বাস (রা.) কে ডেকে পাঠালেন ও জিজ্ঞাসা করলেন, এ উম্মত কিভাবে বিভক্ত হতে পারে অথচ তাদের নবী এক ও কিবলা এক! হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা অধ্যয়ন করেছি এবং জেনেছি কোন ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আর আমাদের পর একদল লোক আসবে যারা কুরআন পড়বে অথচ জানবে না কোন ব্যাপারে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে। ফলে সে ব্যাপারে তারা নিজস্ব মতামত দেবে। আর যখন তাদের নিজস্ব মতামত হবে তারা মতভেদ করবে এবং এভাবে মতভেদ করতে করতেই তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। ১৪ (ইবরাহীম ইবন মূসা ইবন মহুাম্মাদ আল-শাতিবী, আল-মুয়াফাকাত ফী উসূলিল ফিক্হ, তাহকীক: মাশহুর হাসান সালমান, দার আফফান, ১৯৯৭, ৪/২০০)
আল-কুরআন, তাফসীর বুঝার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়
আল-কুরআন সঠিকভাবে বুঝার জন্য আল-কুরআন গবেষণার সঠিক নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। আল-কুরআনের তাফসীর প্রথমত আল-কুরআন দিয়ে করা, তাপর সুন্নাহ দিয়ে এবং তারপর সাহাবাগণের বক্তব্যেও মাধ্যম। তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল আল-কুরআন দিয়ে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা করা। যদি কেউ আল-কুরআনকে বিশুদ্ধরূপে বুঝতে চায় তাহলে তার উচিত সামগ্রিকভাবে আল-কুরআনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং পুরো আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি খেয়াল রাখা। নিম্নে সে সব নিয়ম-নীতির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হল।
১. আল-কুরআন দিয়ে আল-কুরআনের তাফসীরের উদাহরণ : আল্লাহর বাণী, “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন।” এখানে ‘আল্লাহর স্মরণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি আল-কুরআন, নাকি আল্লাহ যে সব কিতাব নাযিল করেছেন সেগুলো, অথবা তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ?
আমরা যদি আয়াতটি পূর্বাপর বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে, ‘আল্লাহর যিকর বা স্মরণ’ দ্বারা এখানে আল-কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, অন্যগুলো নয়, কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা উভয়েই জান্নাত হতে এক সাথে নেমে যাও, তোমরা উভয়েই জান্নাত হতে এক সাথে নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু। অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না।’ আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনালী (কুরআন) এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’।
২. আস-সুন্নাহ আল-কুরআনের ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ হল আল-কুরআনের ব্যাখ্যা। স্বয়ং আল্লাহই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার সুন্নাহর মাধ্যমে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন। আল্লাহ বলেন, “এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি আল-কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা করে।”
৩. আসবাবুন নুযল তথা নাযিলের কারণ ও প্রেক্ষাপট জানা : আল-কুরআন মূলত আল্লাহর কালাম বা বক্তব্য, যার একটি শাব্দিক অর্থ রয়েছে। অনেক সময়ই সে শাব্দিক অর্থ বুঝার জন্য প্রয়োজন সার্বিক প্রেক্ষাপট ও যাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন তাদের বিষয়টি অবগত হওয়া। এটি জানা না থাকলে আল-কুরআনের আয়াত নিয়ে মানুষের মাঝে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা ও সংশয়। বুকাইর নামক একজন আলেম প্রখ্যাত তাবেয়ী নাফে’কে জিজ্ঞাসা করলেন, হারুনী সম্প্রদায় সম্পর্কে ইবন উমার এর অভিমত কেমন ছিল? তিনি বললেন, তিনি তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টির অধম বলে মনে করতেন, কেননা কাফিরদের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতসমূহকে তারা মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত।
আরবী ভাষা জানা
আল-কুরআন সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। আল-কুরআনে এমন সব বিষয় রয়েছে যা বুঝার জন্য প্রয়োজন আরবি ভাষায় পারদর্শী বিশেষজ্ঞ। কেননা আল-কুরআনে সন্নিবেশিত হয়েছে কাব্যিক অভিব্যক্তি, সাহিত্যিক শৈল্পিকতা, আরবি ভাষার অলংকরণ ও বর্ণনাভঙ্গি। অতএব, যে সঠিকভাবে আল-কুরআন নাযিলের নানা প্রেক্ষাপটে আরবদের ‘আদাত-অভ্যাস ও প্রথার’ সাথে পরিচিত হতে হবে। এবং নাহু-ছরফ, বালাগাত, ইলমূল ইশতিকাকসহ আরবী ভাষার ও সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানর্জন করতে হবে। এ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে যদি আমরা এমন তাফসীর পেতে চাই যা আমাদেরকে আল-কুরআন সঠিকভাবে ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ পাঠ করতে হবে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে যার গুরুত্ব বিধৃত হয়েছে।
আল-কুরআন পড়া ও বুঝার সহজ উপায়
১. শিশুকাল থেকে আল-কুরআন সহীহ ও বিশুদ্ধভাবে পড়ার শিক্ষা দেওয়া।
২. আল-কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য আরবী ভাষা বুঝা।
৩. আল-কুরআনের মর্মার্থ উদ্ধারের জন্য বিশুদ্ধ কোন তাফসীর গ্রন্থ নিয়মিত অধ্যয়ন করা।
৪. বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন তাফসীর সংগ্রহ করে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে আয়াত পড়া।
আল-কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যা ৬,২৩৬ এগুলো
তিন বছরে প্রতিদিন ৬টি আয়াত অথবা
চার বছরে প্রতিদিন ৫টি আয়াত অথবা
পাঁচ বছরে প্রতিদিন ৪টি আয়াত অথবা
ছয় বছরে প্রতিদিন ৩টি আয়াত করে মুখস্থ করণ সহ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
৫. Audio-Video মাধ্যম ব্যবহার করে বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও অর্থ বুঝার সুযোগ রয়েছে।
৬. আল-কুরআন শিক্ষার স্বল্প মেয়াদী কোর্সে অংশগ্রহণ করে ছহীহ তেলাওয়াতসহ আল-কুরআন বুঝা সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বের যুলুম, নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার, যিনা-ব্যাভিচার, অধিকার হরণ, নারী নির্যাতন, মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান, লুণ্ঠন, গুম, হত্যাযজ্ঞের মত মারাত্মক বিপর্যয়ের ফলে সমাজে তথা সারা বিশ্বে যে অশান্তি বিরাজমান তা মূলোৎপাটনের এবং সারা বিশ্বের মানব জাতির পথপ্রদর্শনের জন্যে যে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তা সঠিক ভাবে পড়ে ও মর্মার্থ অনুধাবন করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সাধ্যানুযায়ী বাস্তবায়ন করার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
কুরআন প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থা শ্রেষ্ঠ জীবন ব্যবস্থা। আল-কুরআনে নির্দেশিত সিরাতুল মুস্তাকীম অনুসরণ করে, প্রত্যেকেই ইহকালও পরকালের শান্তি লাভ করতে পারে এবং পৌঁছাতে পারে অভিষ্ট লক্ষ্যে। এ জীবন যাপন করতে পারলেই মাটির মানুষ ফিরিশতার চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে। একমাত্র আল-কুরআনই মানুষকে গৌরবের আসনে তুলে ধরতে এবং উন্নত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। যার কোন বিকল্প নেই।
ড. মুহাম্মদ আবু ইউছুফ খান
অধ্যক্ষ
তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা