الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على رسوله الامين وعلى اله واصحابه اجمعين اما بعد:
ভূমিকা
‘অলি আল্লাহ’ একটি ইসলামী পরিভাষা। এটি অলি এবং আল্লাহ শব্দের একত্রিত রূপ। ইসলামে এ পরিভাষাটির গুরুত্ব অপরিসীম। অধুনা বিশ্বে শব্দটির যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। ভ্রান্ত মতাবলম্বি মহল বিশেষ ‘অলি আল্লাহ’ খেতাব ধারণ করে ইসলামপ্রিয় সরলমনা মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালিয়ে ইসলাম তথা শান্তিময় জীবন ব্যবস্থায় অশান্তির বীজ বপন করছে। এহেন অবস্থায় এ পরিভাষাটির কুরআন ও হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণ সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এ ক্ষুদ্র পরিসরে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও বিশ্বনবী দু’জাহানের বাদশা, সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখনিঃসৃত বাণীর আলোকে এ পরিভাষাটির উপর আলোকপাত করছি।
‘অলি’ শব্দের বিশ্লেষণ
‘অলি’ শব্দটি আরবি একবচন। এর বহুবচন ‘আওলিয়া’ যার অর্থ- সাহায্যকারী, বন্ধু, বুজুর্গ, সাধু, পৃষ্ঠপোষক, অভিভাবক, দরবেশ এবং রক্ষক। ‘অলি’ শব্দের অর্থের ব্যাপারে নিম্নলিখিত মনিষীগণের মত:
ক. আল্লামা ফিরোজাবাদী (র.) বলেন, নৈকট্য, মুষলধারে বৃষ্টি।
খ. ইমাম রাযী (র.) বলেন, الولى শব্দের বিপরীত শব্দ العدو বা শত্রু, দুশমন।
গ. আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (র.) বলেন, অলি শব্দের অর্থ- আত্মীয়, নিকটতম, নিকটাত্মীয়।
ঘ. المعجم الوسيط প্রণেতা বলেন, অলি অর্থ- আনুগত্যশীল, যেমন বলা হয়- المؤمن ولى الله (মুমিনগণ আল্লাহর অলি)।
কুরআনে ‘অলি’ শব্দের ব্যবহার
‘অলি’ এবং তার থেকে উৎপন্ন শব্দ (مشتقات) নব্বই বার পবিত্র কুরআনে এসেছে। তন্মধ্যে ৫৪ স্থানে অলি আল্লাহ অর্থে ব্যবহৃত এবং ৩৬ স্থানে এর বিপরীত অর্থাৎ আল্লাহর দুশমনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আল্লাহ’ শব্দের বিশ্লেষণ
‘আল্লাহ’ শব্দটি আরবি। এটি মহান রাব্বুল আলামীনের সত্তাগত নাম। যার অর্থ- উপাস্য, মাবুদ, যিনি একক, অদ্বিতীয়, যার কোন অংশীদার নেই, চিরন্তন, চিরঞ্জীব, অনন্ত অসীম, সর্বদ্রষ্টা, শ্রোতা, জ্ঞানী। মোটকথা هو إسم لذات الواجب الوجود المتجمع لجميع صفات الكمال আল্লাহ এমন এক চিরন্তন সত্ত্বার নাম যার মধ্যে রয়েছে সমস্ত গুণাবলীর পরিপূর্ণতার সমাহার।
কুরআনে ‘আল্লাহ’ শব্দের ব্যবহার
الله শব্দটি إله থেকে গৃহীত। এটি পবিত্র কুরআনে ৬৯৬ বার এসেছে। তন্মধ্যে الله শব্দের শেষে পেশযুক্ত ৯৮১ বার, যবরযুক্ত ৫৯০ বার এবং যেরযুক্ত ১১৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
‘অলি আল্লাহ’র বিশ্লেষণ
পূর্বে বর্ণিত ‘অলি’ এবং ‘আল্লাহ’ শব্দের পৃথক পৃথক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা ‘অলি আল্লাহ’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছি। ولى الله অর্থ- আল্লাহর অলি বা বন্ধু বা নৈকট্য লাভকারী, আল্লাহর প্রিয়বান্দা। এতদসত্ত্বেও ‘অলি আল্লাহ’ সম্পর্কে মনিষীগণ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন-
১. ইবনে হাজার আসকালানী (র.) বলেন:
المراد بولى الله العالم بالله المواظب على طاعته المخلص فى عبادته
অলি আল্লাহ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, তাঁর আনুগত্য অধ্যবসায়ী এবং তাঁর ইবাদাতে একনিষ্ঠতা অবলম্বন করা।
২. ইবন জারীর (র.) বলেন:
الولى هو من كان بالصفات التى وصفه الله بها وهو الذى أمن واتقى
অলি আল্লাহ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে, কুরআনের আলোকে ঈমান এবং তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। যেমন কুরআনের বাণীঃ
الذين أمنوا وكانوا يتقون
৩. تبسيط العقائد الإسلامية গ্রন্থে বলা হয়েছে:
الولى بأنه العارف بالله وبصفاته حسب الإمكان والمواظب على الطاعة والمجتنب المعاصى والمعاصى والمعرض عن الإنهماك فى اللذات والشهوات المباحة
অলি হচ্ছে যথাসম্ভব আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে বিজ্ঞ হওয়া, আনুগত্যশীল ও অধ্যবসায়ী হওয়া, অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকা, হারাম প্রবৃত্তি এবং স্বাদ গ্রহণে লিপ্ত থাকা থেকে বিমুখ থাকা, হারাম প্রবৃত্তি এবং স্বাদ গ্রহণে লিপ্ত থাকা থেকে বিমুখ থাকা।
‘অলি আল্লাহর পরিচয়
‘অলি আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যার কয়েকটি নিম্নে পেশ করা হল:
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে:
المؤمنون والمؤمنات بعضهم أولياء بعض يأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر ويقيمون الصلوة ويؤتون الزكاة ويطيعون الله ورسوله اولئك ميرحمهم الله ان الله عزيز حكيم-
আর ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ একে অপরের সহায়ক (বন্ধু)। তারা পরস্পরকে সৎ কাজের আদেশ দেয়, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, এঁদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।
হাদীসের আলোকে
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স) বলেছেন, আল্লাহর এমন কতিপয় বান্দা রয়েছেন যারা নবী নন, কিন্তু নবী ও শহীদগণ তাদের ব্যাপারে ঈর্ষা করেন। বলা হলো তারা কারা? আমরা তাঁদেরকে ভালবাসবো! রাসূল (স) বললেন, তারা এমন সম্প্রদায় যারা আত্মীয়তা ও বংশীয় বন্ধন ছাড়াই আল্লাহর দেখানো পথে একে অপরকে ভালবাসে, তাদের চেহারা আলোক বর্তিকার ন্যায় উজ্জ্বল। মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়< তখন তারা ভয় পায় না এবং মানুষ চিন্তিত হয়, তখন তারা চিন্তিত হয় না। অত:পর রাসূল (স.) কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেন: সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই।
কুরআন ও হাদীসের ভাষায় প্রকৃত অলি কারা
পূর্বে আলোচনা হয়েছে অলি শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি কুরআনিক পরিভাষা। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছেঃ
إنما وليكم الله ورسوله والذين أمنوا الذين يقيمون الصلوة ويؤتون الزكاة وهم راكعون- ومن يتولى الله ورسوله والذين امنوا فان حزب الله هم الغلبون-
নিশ্চয়ই তোমাদের বন্ধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং বিনয়ী। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর পক্ষ হিসেবে বিজয়ী। আল-কুরআনের এ ঘোষণার আলোকে বলা যায় যে, মুমিনদের প্রকৃত অলি হচ্ছে:
ক. আল্লাহ তা’আলা। কেননা প্রকৃত অলি ও সাহায্যকারী সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় তিনি হতে পারেন যিনি চিরঞ্জীব, নশ্বর। তাঁর সম্পর্ক ছাড়া যত সম্পর্ক সবই ধ্বংসশীল।
খ. রাসূল (স) এ ক্ষেত্রেও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’আলারই অলি। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা বলেন,
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله
হে আল্লাহ! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর।
অর্থাৎ যিনি আল্লাহ তা’আলার ভালবাসা লাভ করতে চান, তার উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূল (স) এর সুন্নতের অনুসরণ করা।
গ. মুসলমানগণ, যারা সত্যিকার অর্থে সালাত আদায় করেন, যাকাত প্রদান করেন এবং বিনয়ী ও স্বীয় সৎ কর্মের জন্য গর্বিত নয়।
যারা উপরোক্ত তিন শ্রেণিকে প্রকৃত অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে তারা সফলকাম। তাদের ইহকাল এবং পরকালে চিন্তার কোন কারণ নেই।
হাদীসে এসেছে
হযরত উবাইদ ইবন উমাইর (রা) হতে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (স) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, সাবধান! আল্লাহর অলি হচ্ছেন তারাই যারা পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করে, নিজের উপর আল্লাহর অধিকার মনে করে সওয়াবের আশায় রোযা রাখে, সওয়াব প্রাপ্তির নিমিত্তে স্বীয় সম্পদের যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বড় বড় গুণাহ থেকে নিজেকে দূরে রাখে।
‘অলি আল্লাহর বৈশিষ্ট্য
১. ঈমান গ্রহণ করা।
২. সালাত কায়েম করা।
৩. যাকাত প্রদান করা।
৪. সৎ কাজের আদেশ করা।
৫. অসৎ কাজে নিষেধ করা।
৬. আল্লাহর আনুগত্য করা।
৭. তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা।
৮. আল্লাহর অধিকার মনে করে সওয়াবের আশায় রোযা রাখা।
৯. গুনায়ে কবীরা থেকে বেঁচে থাকা।
‘অলি আল্লাহদের আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য
يقول (ابو عبد الله السرى) علامة الأولياء ثلاث: تواضع عن رفعه وزهد عن قدرة وإنصاف عن قوة-
হযরত ইয়াহইয়া ইবন মুয়ায (র.) বলেন: অলিদের বৈশিষ্ট্য তিনটি:
১. সর্ব বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা।
২. সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকেই যথেষ্ট মনে করা।
৩. সর্বাবস্থায় তাঁর দিকে ফিরে যাওয়া।
ক. হযরত আবুল হাসান ইবন আতা (র.) বলেন: অলিদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে চারটি হলো:
১. নিজের গোপন বিষয়াবলী তার এবং আল্লাহর মাঝে সংরক্ষণ করা।
২. নিজের অংগ প্রত্যঙ্গ তার এবং আল্লাহর মাঝে সংযত রাখা।
৩. তার এবং মানুষের কষ্ট বহন করা।
৪. বিবেকের তারতম্য সত্ত্বেও সুন্দর আচরণ করা।
খ. শায়েখ আব্দুর রহমান দামেস্কী (র.) অলি আল্লাহর বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেন:
১. আরাকানে সিত্ত্বাহ তথা আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, ঐশী গ্রন্থসমূহ, নবীগণ এবং ভাগ্যের ভালমন্দের উপর পূর্ণ ঈমান থাকা।
২. কুরআন এবং সুন্নাতের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়া এবং বিদআ’তীদের পথ পরিহার করা।
৩. বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রেই কুরআন মোতাবেক চলা। অর্থাৎ দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন না করা।
তিনি আরো বলেন, অলি আল্লাহদের সর্বদা নিম্নের কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে:
১. বিদআ’ত থেকে মুক্ত থাকা। বিদআ’ত হচ্ছে البدعة ما استحدث فى الدين على وجه القربة তথা- নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন কাজকে ইবাদত হিসেবে সংযুক্ত করা।
২. দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা।
৩. কুরআনের অনুসরণ না করে মনগড়া এবাদতে মগ্ন থাকা।
মোটকথা, অলির মূল ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও হাদীস অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই কুরআন ও হাদীসের বিধানকে প্রাধান্য দেয়া।
অলিদের প্রকারভেদ
শায়েখ আব্দুর রহমান দামেস্কী (র.) বলেন, ولى শব্দটি ولاية শব্দ থেকে গৃহীত। এটি পাঁচ প্রকার:
১. الولاية العظمى (মহান অভিভাবক) যেমন কুরআনের বাণী:
الله ولى الذين أمنوا يخرجهم من الظلمات إلى النور والذين كفروا واليائهم الطاغوت يخرجونهم من النور إلى الظلمات اولئك أصحاب النار هم فيها خالدون.
যারা ঈমান গ্রহণ করেছে আল্লাহ তাদের অলি-অভিভাবক। তাদেরকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফরী করে তাদের অলি-অভিভাবক হচ্ছে ‘তাগুত’। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।
অন্য আয়াতে রয়েছে: هنالك الولاية لله الحق এক্ষেত্রে সর্বময় অধিকার স্বত্ত্ব আল্লাহর।
এছাড়া রাসূল (স.) অহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের জবাব প্রদানে বলেন, الله مولنا ولا مولى لكم আল্লাহ আমাদের অভিভাবক, অলি, তোমাদের কোন অভিভাবক নেই।
সুতরাং ولاية لله এর মর্মার্থ হচ্ছে- আল্লাহ মুমিনদেরকে সাহায্য করেন, তাদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর করেন এবং অন্তর থেকে দুশ্চিন্তার অবসান ঘটান।
২. ولاية النبى للمؤمنين (মুমিনদের জন্য নবী করীম (স) এর অভিভাবকত্ব)।
যেমন কুরআনের বাণী: النبى بالمؤمنين من أنفسهم নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ। এছাড়া রাসূল (স) নিজেই বলেছেন: أنا أولى بالمؤمنين من أنفسهم আমি মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ।
৩. ولاية الظلمين للظالمين (অত্যাচারীদের জন্য অত্যাচারী অভিভাবক)। যেমন কুরআনের বাণী:
إن الظالمين بعضهم أولياء بعض والله ولى لمتقين জালিমরা একে অপরের বন্ধু আর আল্লাহর পরহেজগারদের বন্ধু।
যেমন: কুরআনের বাণী- إنا جعلنا الشياطين أولياء الذين لا يؤمنون নিশ্চয়ই আমি শয়তানদেরকে তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি যারা ঈমান গ্রহণ করেনি।
৪. ولاية الشياطين الكافرين (কাফেরদের জন্য শয়তানের অভিভাবকত্ব)।
যেমন- কুরআনের বাণী: إنا جعلنا الشياطين أولياء الذين لا يؤمنون নিশ্চয়ই আশি শয়তানদেরকে তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি যারা ঈমান গ্রহণ করেনি।
৫. ولاية الطاغوت তাগুতের অভিভাবকত্ব হচ্ছে একটি মিথ্যা, বানোয়াট, ধোঁকাবাজী ও প্রতারণামূলক চক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী:
وقال الشيطان لما قضى الامر ان الله وعدكم وعد الحق ووعدتكم فأخلفتكم وما كان لى عليكم من سلطان إلا أن دعوتكم فاستجبتم لى، فلا تلومنى ولوموا أنفسكم، ما أنا بعصرخكم وما أنتم بمصرخى، إنى كفرت بما أشركتمونى من قبل، إن الظالمين لهم عذاب اليم.
যখন সব কাজের ফয়সালা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে: নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলাম, অত:পর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোন ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অত:পর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করো না এবং নিজেদেরকেই ভর্ৎসনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতিপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয়ই যারা জালিম তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
ত্বাগুত শব্দের বিশ্লেষণ
‘তাগুত’ অভিধানিক অর্থে এমন প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে। কুরআনের পরিভাষায় তাগুন এমন বান্দাকে বলা হয়, যে বন্দেগী ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু ও খোদা হবার দাবীদাা সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের বন্দেগী ও দাসত্বে নিযুক্ত করে।
আল্লাহর মোকাবিলায় বান্দার প্রভুত্বের দাবীদার হওয়া এবং বিদ্রোহ করার তিনটি পর্যায় আছে:
প্রথম পর্যায়: বান্দা নীতিগতভাবে তাঁর শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করে। একে বলা হয় ‘ফাসেকী’।
দ্বিতীয় পর্যায়: সে আল্লাহর শাসন কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় ‘কুফরী’।
তৃতীয় পর্যায়: সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং তার প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে। এই শেষ পর্যায়ে যে বান্দা পৌছে যায় তাকেই বলা হয় ‘তাগুত’। কোন ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোনদিন সঠিক অর্থে আল্লাহর মু’মিন বান্দা হতে পারে না।
অলি আল্লাহদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, অলি আল্লাহর দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় দায়িত্ব কর্তব্যের বর্ণনা দেয়া হল:
১. কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। এ সম্পর্কে ইমাম জুহুরী (র) বলেন:
كان من مضى من علمائنا يقولون الإعتصام بالسنة نجاة وقال مالك السنة سفينة نوح من ركبها نجا ومن تخلف عنها غرق
আমাদের অতীত ওলামায়ে কেরাম বলেন, সুন্তকে আঁকড়িয়ে ধরা, ইমাম মালেক (র.) বলেন- সুন্নত হচ্ছে নূহ (আ.) এর নৌকার ন্যায়… যে তাতে আরোহন করবে সে মুক্তি পাবে এবং যে তা থেকে পিছনে থাকবে সে ডুবে মরবে।
২. আল্লাহ তা’আলার প্রতি পূর্ণ ঈমান রাখা।
৩. স্বীয় আত্মীয়ের প্রতি যত্মশীল হওয়া।
৪. পিতা-মাতা তথা আত্মীয়-স্বজন ও মুরুব্বীদের শরীয়তসম্মত আদেশের আনুগত্য করা।
৫. সন্তান-সন্তুতি তথা নিজের অধীনস্থদের প্রতি সহনশীল ও স্নেহময়ী হওয়া।
৬. প্রতিবেশীদের অধিকার আদায়ের প্রতি সজাগ থাকা।
৭. সমাজ ও দায়িত্বশীলদের প্রতি সদাচারণ, কল্যাণ, সৎপরামর্শ ও ক্ষমাশীল হওয়া।
৮. সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদা দা’য়ী ইল্লাল্লাহ’র ভূমিকা পালন করা।
৯. নিঃশর্ত ও বিনিময়হীনভাবে দ্বীনের জন্য কাজ করা।
১০. অন্যের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া।
১১. কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান প্রচার করা।
১২. দ্বীন ও তাকওয়ার পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা।
অলি আল্লাহ ও বর্তমান সমাজ
বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কুরআন সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে বিভিন্ন দেশ এবং জনগোষ্ঠীর মাঝে এক শ্রেণীর লোক নিজেদেরকে অলি আল্লাহ পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে নিজেদের অনুসারিদের মাঝে প্রচার করছে। এবং বৈষয়িক জীবনে উন্নতি সাধনে বিভিন্ন নিত্য নতুন কলাকৌশল আবিস্কার করছে। সহজ, সরলমনা অজ্ঞতাবশত অন্যায়ে লিপ্ত মানুষদেরকে মস্তিস্ক প্রসূত ও নিজেদের আবিস্কৃত বিদ’আতী (যেমন- কবর পূজা, কবরের নামে মান্নাত করা, কবরের নামে কুরবানী করা, বরকত লাভের আশায় গাছের সাথে লাল সূতা বাঁধা, নির্দিষ্ট সময়ে ভোজনের আয়োজন করা, পীরের নামে মান্নত করা ইত্যাদি) পথ ও মতকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে তাদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করছে। ফলে এ ধরণের অধম ব্যক্তিরা কুরআন ও হাদীসের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এ মুহুর্তে অলি আল্লাহ তথা সত্যিকার ঈমানদারদের দায়িত্ব হবে, এ প্রকৃতির স্বঘোষিত অলি আল্লাহ নামধারী ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে জাতিকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশিত ইসলাম বিরোধী মত ও পথকে দুরীভূত করে ইসলামে সঠিক ব্যাখ্য ও বিশ্লেষণ তাদের নিকট পৌঁছে দেয়া। যার প্রতি নির্দেশ করে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে:
فلو لا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذر واقومهم إذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون-
তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যারা দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁতে পারে।
উপসংহার
‘অলি আল্লাহ’ শিরোনাম প্রবন্ধে এ যাবৎ যা আলোচনা করা হলো, তাতে একথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, প্রতিটি মুসলমান নর-নারী অলি আল্লাহর অন্তর্ভূক্ত। বিশেষ কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে অলি আল্লাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা কুরআন ও হাদীস তথা ইসলামী শরীআতের পরিপন্থী। একজন সত্যিকার ঈমানদার হিসেবে অলি আল্লাহর দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নিজে সজাগ থেকে, আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার পথ উন্মোজন করতে হবে। অতএব, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমাদের ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাদের সকলকে অলি আল্লাহর অন্তর্ভূক্ত করে তাঁর ঘোষিত সফলতা লাভের তৌফিক দান করেন। আমীন।
১. আল কমুসূল জাদীদ, বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী।
২. فتح القدير দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৫৭।
৩. أولياء الله পৃষ্ঠা-৮৯।
৪. فتح البارى খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-৩৪৩।
৫. তাফসীর ইবন জারীর আততাবারী, খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-৯২।
৬. ছহীত ইবন হাব্বান, খণ্ড-তৃতীয়, পৃষ্ঠা-৩৩২।
৭. সূরা মায়েদা, আয়াত নং-৫৫
৮. المستدرك ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৭।
৯. শু’আইবুল ঈমান, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০।
১০. শু’আইবুল ঈমান, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯৭।
১১. শু’আইবুল ঈমান, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৫।
১২. مجمع الفتاوى ১খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৩।
১৩. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-২৫৭।
১৪. সূরা ক্বাহাফ, আয়াত নং-৪৪।
১৫. أضواء البيان للشنقيطى র ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮৯।
১৬. সূরা জাসিয়া, আয়াত নং-১৯।
১৭. সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২৭।
১৮. সূরা ইব্রাহীম, আয়াত নং-২২।
১৯. তাহফীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত-২৫৬।
২০. আচ্ছাফদীয়া, ১ম খণ্ডের ২৫০ পৃষ্ঠা।
২১. সূরা তাওবা, আয়াত নং-১২২।
ড. মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ খান
অধ্যক্ষ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা