শিক্ষক হচ্ছেন জাতি বিনির্মানের কারিগর। শিক্ষার্থীদের অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে মুলত একজন শিক্ষককে বহুমুখী তৎপরতায় সম্পৃক্ত হতে হয়। হতে হয় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং অসাধারণ অনেক ইতিবাচক গুণাবলীর প্রতীক । শিক্ষক তাঁর নিপুন ছোঁয়ায় এবং ছাঁয়ায় শিক্ষার্থীদেরকে যে শিক্ষা দান করেন তার মাধ্যমে খুলে যায় তাদের রহস্যময় মনোজগত, কল্পনাশক্তি ও কর্মদক্ষতা। এ কারণেই শিক্ষককে হতে হয় তাঁর মহান পেশার প্রতি উৎসাহী এবং অনরাগী।
ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষককে দেওয়া হয়েছে বাবার মর্যাদা। তাই একজন শিক্ষকের ছাত্রের প্রতি বাবার মতো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। সন্তানকে সুশিক্ষিত করার ব্যাপারে যে রকম বাবা-মাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, সেরকম শিক্ষককেও ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ ও সভ্যতা শিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একিভাবে একজন শিক্ষকের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে উন্নত সভ্যতা ও বিশ্ব শান্তির সহায়ক হতে পারে। সভ্যতা বিনির্মানের অগ্রদূত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক সায়্যেদেনা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) তাই নিজেকে ঘোষণা দিলেন: ‘আর নিশ্চয় আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’।
শিক্ষকের কাজ:
কুরআনে নবীজির যে চারটি প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সবক’টি শিক্ষকের কাজ। যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওহি তথা কুরআনের আয়াতগুলো পাঠ করে শুনানো; অব্যাহত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আকিদা, বিশ্বাস ও আমল-আখলাকের পরিশুদ্ধকরণ; কুরআনের বিধানাবলির জ্ঞান দান এবং হিকমাহ শিক্ষা দান।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের কাজ হচ্ছে বাস্তব জীবন ও সক্রিয় অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করা, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করা, কোন প্রকার সমস্যা যেন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে- সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীর সর্বতোমুখী বিকাশ সাধনে সহায়তা করা। আধুনিককালে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে বক্তৃতাদানের মাধ্যমে শিক্ষাদান দ্বারা শিক্ষার্থীর ক্ষমতা, আগ্রহ, প্রবণতা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা প্রভৃতি বিবেচনা শিক্ষকের কাজের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি হচ্ছে মনোবিজ্ঞানভিত্তিক আর এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিকতা। এই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীর মনকে আন্তরিকতা ও অধ্যবসায়ের সাথে অধ্যয়ণ করা অথাৎ শিক্ষামনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। শিক্ষকের অন্যতম কাজ হচ্ছে শিক্ষাকে সমাজধর্মী করে তোলা। কারণ ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সমাজ সচেতনাবোধ পরস্পর সমন্বয়ে তৈরি। জন ডিউইর মতে, “শিক্ষকের দায়িত্ব হল বিদ্যালয়ে এই সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা।”
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমে নির্ধারণেও শিক্ষকের যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন। গতানুগতিক পাঠ্যক্রমে শুধুমাত্র তত্ত্বমূলক জ্ঞানই স্থান পেত। আধুনিক পাঠ্যক্রমে জীবন ও সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে শিক্ষার্থীকে জীবনধর্মী ও সমাজধর্মী করে তোলার জন্য শিক্ষকের যথেষ্ট অভিজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে ও স্বত:স্ফুর্ত আচরণ বিকাশে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর ভূমিকা অনন্য। আর এ সমস্ত কাজের প্রধান সহায়ক হচ্ছেন শিক্ষক। পারসিভাল রেন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বন্ধু, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক বলে অভিহিত করেছেন। শিক্ষক শুধু তত্ত্বের পরিবেশকই নন, তিনি শিক্ষার্থীর বন্ধু, জীবনাদর্শ গঠনের সহায়ক এবং সুপরিচালক।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের কার্যাবলী নিম্নরুপ:
(১) নির্দেশনা দান : শিক্ষার্থীরা সবসময় শিক্ষকদের নিকট থেকে যথাযথ নির্দেশনা লাভের প্রত্যাশা করেন। শিক্ষার্থীরা সহজভাবে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা, সমস্যা ও সমাধানের ইঙ্গিতগুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে । নির্দেশক হিসেবে শিক্ষককে সবসময় শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমিক ও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীতে উৎসাহ প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য সাহায্য করা এবং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।
(২) উৎসাহ দান : শিক্ষকের অন্যতম কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ উদ্দীপনা দান করা। শিক্ষক উৎসাহ উদ্দীপনার সাহায্যে শিক্ষার্থীর সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশসাধন করেন। এই উৎসাহ উদ্দীপনা শিক্ষার্থীর জ্ঞান আহরণে সহায়তা করে। ডানহিলের মতে, His (teacher) job is to set the child’s mind in fire.
(৩) ব্যাখ্যা দান : শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিক্ষনীয় বিষয়বস্তুর, সমস্যা ও সমাধানের উপায়গুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন। শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, সামাজিক চাহিদা প্রয়োজন ও বিদ্যালয়ে উদ্ভূত সমস্যা, সমাধান ইত্যাদি ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা এবং ব্যাখ্যা দান করা শিক্ষকের অন্যতম কাজ। শিক্ষক যদি এই সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যাখ্যাদান না করতে পারেন,তাহলে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান ও বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধন হবে না।
(৪) পেশা বা বৃত্তি নির্বাচন : আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের নাগরিক। সুনাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতে জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একান্ত কাম্য। এ ব্যাপারে স্কুল জীবনেই তাকে উপযুক্ত পেশা বা বৃত্তি নির্বাচন করতে হবে। আর এই পেশা বা বৃত্তি নির্বাচনে শিক্ষকই হচ্ছেন প্রধান ব্যক্তি যিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন।
(৫) মূল্যবোধ পরিবেশন : ব্যক্তিজীবনে মূল্যবোধ জাগরণের মাধ্যমেই তার পূর্ণতা সাধিত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ইত্যাদি সকল প্রকার মূল্যবোধই আজ ব্যক্তিজীবনের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু কোন মূল্যবোধ শিক্ষার্থীর নিকট অধিক ফলপ্রসূ এবং কাম্য, শিক্ষকদের তা নির্বাচন করতে হবে। সমাজে যে সমস্ত মূল্যবোধ কাম্য এবং শ্রেয়, সেগুলোই শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং শিক্ষার্থীরা যাতে এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট ও অনুসরণ করে, শিক্ষককে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৬) পরিচালনা : শিক্ষার্থীদের শিক্ষনীয় জীবনে অনেক সময় এমন দ্বন্দ্বমূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেখানে তারা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে শিক্ষককে উপযুক্ত নির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে হয়। শিক্ষকের উৎসাহ উদ্দীপনা, পরামর্শ, নির্দেশনা, সাহায্য ও সহানুভূতি তাদের সঠিক পথ নির্দেশ করতে সহায়তা করে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক হবেন সহায়ক বন্ধু ও পথ প্রদর্শক
(৭) সমন্বয় সাধন : সামাজিক শক্তি হিসেবে শিক্ষক বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরিবহনের মাধ্যমে সামাজিক বিবর্তন, ধারাবাহিকতা, মূল্যবোধ, জীবনাদর্শ ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিভাত করার কাজে তিনি সংযোগকারী সেতু হিসেবে কাজ করবেন।
শিক্ষকের গুণাবলী
সার্থক শিক্ষার সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করে তুলতে হলে যেমন শিক্ষার্থীদের উপযোগী পাঠ্যসূচির প্রয়োজন, উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষকের। শিক্ষক যদি উপযুক্ত না হন, তাহলে শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য । একজন শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীদের সর্বতোমুখী বিকাশ সাধনের সহায়ক হতে পারেন, তেমনি একজন অযোগ্য শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্ভাবনাময়- প্রতিভার অকাল মৃত্যু ঘটিয়ে তার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলতে পারেন। সমাজ জীবনে একজন সৎ নাগরিকের যে সমস্ত গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে একজন শিক্ষকেরও সেই সমস্ত গুণাবলী থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া সুশিক্ষক হতে হলে তাকে কতকগুলো বিশেষ গুণের অধিকারী হতে হয়। এ গুণের অনেকটাই জন্মগত। ‘শিক্ষক তৈরি করা যায় না- শিক্ষক জন্মান’ এ প্রবাদ বাক্যটি মিথ্যা নয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক ব্যবহারিক গুণগুলোই শেখেন। শিক্ষকের মানবীয় গুণাবলী সহজাত। ব্যবহারিক ও মানবীয় গুণের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই একজন শিক্ষক সুষ্ঠুভাবে শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হন। শিক্ষকের গুণাবলী সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা করা হয়েছে। শিক্ষকের কোন কোন গুণ শিক্ষাদানের পক্ষে সহায়ক, কোন কোন গুণ শিক্ষার্থী পছন্দ করে, শিক্ষার সঙ্গে কি কি গুণের সম্পর্ক রয়েছে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ শিক্ষক সম্পর্কে বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গুণগুলোকে সাধারণত: তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
(ক) ব্যক্তিগত গুণাবলী
(খ) পেশাগত গুণাবলী
(গ) আচরণগত গুণাবলী
ক. শিক্ষকের ব্যক্তিগত গুণাবলী
শিক্ষকের যে সব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ফলপ্রসূ শিক্ষার সহায়ক, সেগুলোকেই ব্যক্তিগত গুণাবলী বলা হয়। এই গুণগুলোর মধ্যে কতকগুলো সহজাত বৈশিষ্ট্যরূপে ব্যক্তির মধ্যেই থাকে আর কতকগুলো গুণ অর্জিত। ফলে অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই আংশিক সহজাত এবং আংশিক অর্জিত। একজন সুশিক্ষকের ব্যক্তিগত গুণাবলীর একটি তালিকা নিনে¤œ প্রদান করা হল:
(১) ব্যক্তিত্ব : একজন শিক্ষককে সুসমন্বিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। তাঁঁর আচরণে এবং চিন্তাভাবনায় একটা সুসংহত রূপ থাকবে। খামখেয়ালী ভাব বা অস্থিরচিত্ততা শিক্ষকের শিক্ষাদানকে পদে পদে ব্যর্থতায় ভরে তোলে। ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষক সবার নিকট হেয় প্রতিপন্ন হন। তাঁকে শিক্ষার্থীর সঙ্গে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে মিলামিশা করতে হবে। তাঁর ব্যক্তিত্ব হবে প্রীতিময়, সৌহার্দ্যভিত্তিক ও আকর্ষণীয়।
(২) বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা : শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষার্থীকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খলভাবে বিদ্যালয়ের পরিবেশে পরিচালনা করতে প্রচুর বুদ্ধি, বিচারবোধ,বিচক্ষণতা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। কারণ শিক্ষক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা, জটিল বিষয়ের সমাধান উদ্ভাবন করা, শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধভাবে পরিচালিত করা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তাঁকে সম্পন্ন করতে হয়। অতএব তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, বিচার শক্তি, মানসিক ক্ষমতা, সাধারণ জ্ঞান প্রভৃতি সাধারণ মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট স্তরের হওয়া প্রয়োজন।
(৩) সুবিবেচনা : একজন শিক্ষকের পক্ষে সুবিবেচক হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের কাজের যথাযথ মূল্যদান, কোমলতা, সৌহার্দ্য, সহানুভূতি, ন¤্রতা, ভদ্রতা, সাহায্য করার মনোভাব, ধৈর্য, সহনশীলতা প্রভৃতি সুবিবেচনা প্রসূত গুণাবলীর অর্ন্তগত। এই গুণগুলো শিক্ষার্থীকে শিক্ষাকার্যে শিক্ষক উদ্ভুদ্ধ করা অপরিহার্য।
(৪) হাসি খুশি ও প্রফুল্লতা : সুশিক্ষকের আর একটি গুণ হল প্রফুল্লতা এবং হাসিখুশি ভাব। প্রফুল্লতা বলতে প্রতিকুল পরিবেশে অবদমিত না হয়ে পরিবেশকে আয়ত্ব করা, মনে সাহস ও আশা রাখা এবং যে কোন পরিস্থিতিতে হাসিখুশিভাব বজায় রাখা। শিক্ষাদান কাজে এবং ছাত্রদের সঙ্গে মিলামিশার সময় শিক্ষক নানা অবাঞ্ছিত এবং প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন হতে পারেন। সেই পরিস্থিতি এবং পরিবেশের নিকট যদি তিনি পরাজয় বরণ করেণ, তবে তাঁর পক্ষে শিক্ষাদানই সম্ভব হবেনা।
(৫) দায়িত্বশীলতা : শিক্ষাদানে শিক্ষক হবেন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কারণ তাঁর উপর শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে । তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব শিক্ষার্থীর উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষক যদি দায়িত্বশীল না হন অথবা দায়িত্ব পরিহার করে চলার মনোভাব পোষণ করেন, তবে সেই শিক্ষক দ্বারা কখনও শিক্ষাদান কার্য চলতে পারে না এবং শিক্ষার্থীরা কোনরূপ উপকৃত হবে না। সেজন্য শিক্ষকের আচরণ, মন্তব্য, চিন্তাধারা, মনোভাব প্রভৃতি যথেষ্ট সংযত এবং সুনিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় শিক্ষার্থীর বিকাশোন্মুখ ব্যক্তিসত্তা ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
(৬) উদারতা : শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় উদার হওয়া প্রয়োজন। কারণ শিক্ষক যদি উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের অধিকারী না হন, তাহলে শিক্ষার্থীর কাজের যথাযথ মূল্যায়ন তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। সংকীর্ণ ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের মূল্যয়ন করলে তারা কখনও উপকৃত হবে না এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা ঘটবে না। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছাত্রদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন কখনও সম্ভব হয় না। শিক্ষক কখনও নিজের পছন্দ-অপছন্দ বা ব্যক্তিগত মনোভাব ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিবেন না, এতে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের একটা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হবে।
(৭) প্রগতিশীলতা : শিক্ষককে সব সময় প্রগতিশীল মনোভাবের অধিকারী হতে হবে। সমাজ ও জীবনের পরস্পর পরিবর্তশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। শিক্ষক যদি সনাতনী এবং রক্ষণশীল মনোভাবের অধিকারী হন, তাহলে আধুনিক পদ্ধতি ও ভাবধারা অনুযায়ী শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ নতুনকে বরণ করে নিয়ে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার নামই প্রগতি।
(৮) সুস্বাস্থ্য : শিক্ষকের প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। শিক্ষকের স্বাস্থ্যের উপর তাঁর শিক্ষণের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে। স্বাস্থ্যহীন বা সদা-অসুস্থ শিক্ষক কখনও সন্তোষজনকভাবে শিক্ষা দিতে পারে না এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার করতে পারেন না । সুস্বাস্থ্য হচ্ছে শিক্ষকের একটি আকর্ষনীয় গুণ। স্বাস্থ্য সম্পর্কে হার্বার্ট স্পেন্সার একটা সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে,“ জীবনকে উন্নত করার প্রধান উপায় হচ্ছে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া।” জন লক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনপ্রিয় ল্যাটিন প্রবাদটি উদ্বৃত করেছেন- সুস্থদেহে সুস্থ মন। সুতরাং সুস্বাস্থ্যই হচ্ছে ব্যক্তিত্বের প্রধান উপাদান। দৈহিক এবং প্রাণশক্তিসম্পন্ন শিক্ষকের কাজের মধ্যে আশাবাদ, উৎসাহ- উদ্দীপনা প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
(৯) সহজ, সরল, অমায়িক : শিক্ষক হবেন সব সময় সহজ, সরল অমায়িক। তাহলে ছাত্ররা শিক্ষকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে পারবে। শিক্ষক যদি গুরুগম্ভীর এবং কঠোর মনোভাবাপন্ন হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষকের সঙ্গে কখনও অন্তরঙ্গভাবে মিলতে পারবে না এবং তাকে সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্ট করবে না। নিজেদেও অসুবিধা বা সমস্যা কখনও তারা সেই শিক্ষকের নিকট প্রকাশ করবে না। উপরন্তু উক্ত শিক্ষকের প্রতি একটা বিরূপ এবং অনীহাভাব ছাত্ররা সব সময় পোষণ করবে যা শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করে।
(১০) আত্মবিশ্বাস : আত্মবিশ্বাস শিক্ষকের নিকট বড় গুণ। শিক্ষকের মধ্যে সব সময় একটি গভীর আত্মবিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। শিক্ষক আত্মবিশ্বাস নিয়ে শিক্ষাদানে ব্রতী হবেন। যদি কোন অসুবিধা, সমস্যা বা ছাত্র-ছাত্রীদের ভুলত্রুটি দেখে তিনি হতাশ এবং নিরাশ হন এবং সাফল্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা না করেন, তবে তিনি শিক্ষাদানে সাফল্য অর্জন করতে পারবেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরিয়া দিয়ে সব অসুবিধা ও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকের ব্যক্তিত্বে বিশ্বাসী না হয়, তবে তারা তাঁকে যথাযথভাবে অনুসরণ করবে না এবং এক্ষেত্রে শিক্ষাদান ব্যর্থ হতে বাধ্য।
(১১) কণ্ঠস্বর : শিক্ষাদানে কণ্ঠস্বর একটি মূল্যবান উপাদান। শ্রেণিকক্ষে পরিষ্কার, সুমধুর এবং সুন্দরভাবে উঠানামা করতে পারে এমন স্বরই শিক্ষাদানের জন্য উৎকৃষ্ট। শক্তিসম্পন্ন কর্কশ স্বর অথবা উচ্চ গ্রামসম্পন্ন স্বর সর্বদা পরিহার করা উচিত। আবার ক্ষীণ ও নি¤œস্বরও কাম্য নয়। কারণ এরূপ স্বরের মধ্যে কোন প্রকার দৈহিক শক্তি, বেগ বা দৃঢ়তা প্রকাশ পায় না। নীরস বা কাঠখোট্টা স্বর খুব তাড়াতাড়ি ছাত্রদের ক্লান্ত করে তোলে এবং এর মধ্যে ছাত্ররা কোন প্রকার আকর্ষণ অনুভব করে না। সংক্ষেপে সুন্দর কণ্ঠস্বর একজন শিক্ষককে কৃতকর্মে সফলকাম হতে সাহায্য করে।
(১২) বাচনভঙ্গি : শিক্ষকের বাচনভঙ্গি সুন্দর, স্পষ্ট এবং আকর্ষণীয় হওয়া প্রয়োজন। ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এই গুণটির বিশেষ অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক কিছু জানা সত্তেও বাচনভঙ্গির অভাবে নিজের মনোভাব ছাত্রদের নিকট উপস্থাপিত করতে পারেন না। বাচনভঙ্গি সুন্দর এবং স্পষ্ট না হলে ছাত্ররা শিক্ষকের বক্তব্য বুঝতে পারে না। ফলে শিক্ষকের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ থাকে না, পাঠে মন বসে না এবং ক্লাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় রত থাকে।
(১৩) চরিত্র : সর্বোপরি শিক্ষককে সৎচরিত্রের অধিকারী হতে হবে। সরল, সৎ,অকপটচিত্ত, ন্যায়পরায়ণ, কর্তব্যপরায়ন ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী না হলে শিক্ষক শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবেন না। শিক্ষক যে উপদেশ দেন, তা যদি তিনি বাস্তবে অনুসরণ না করেন, তবে ছাত্রদের নিকট তাঁর উপদেশের কোন মূল্য থাকবে না। শিক্ষকের নিকট সুবিচার পাবে বলে যদি ছাত্রদের বিশ্বাস না থাকে, তবে তারা কখনও উক্ত শিক্ষকের নেতৃত্ব মেনে নেবে না।
খ : পেশাগত গুণাবলী
শিক্ষকের ব্যক্তিগত গুণাবলী ছাড়াও তার আরও কতকগুলো গুণ থাকা প্রয়োজন- যা তাকে শিক্ষাদান কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে। এই গুণগুলো হচ্ছে পেশা বা বৃত্তিকেন্দ্রিক। শিক্ষকতা পেশায় একজন শিক্ষকের এই সমস্ত গুণাবলীর অধিকারী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। একজন শিক্ষকের পেশাগত গুণাবলী নি¤œরূপ হওয়া প্রয়োজন :
(১) বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন : শিক্ষনীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা একজন শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য । শুধুমাত্র শিক্ষনীয় বিষয় একমাত্র শিক্ষার বিষয় নয়-আধুনিক জ্ঞানের সকল শাখার সঙ্গেই শিক্ষকের স্বল্পবিস্তর পরিচয় থাকা বাঞ্ছনীয় এভারেস্ট ডিন.মার্টিন তার Meaning of liberal education গ্রন্থেও এক জায়গায় বলেছেন, “ একজনকে ভাল শিক্ষক হতে হলে তাকে ভাল ছাত্র হতে হবে। ” জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে পড়ার অভ্যাস, অনুশীলন করা। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের বহুমুখী কৌতুহল ও জ্ঞানস্পৃহাকে তৃপ্ত করতে পারেন, তিনিই সুশিক্ষত।
(২) আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান : শিক্ষার সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষাদান পদ্ধতির উপর। আধুনিককালে শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি সর্ম্পকে নিত্যনতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পদ্ধতি সর্ম্পকে De garmo বলেছেন,“ আধুনিক যে কোন আর্দশ শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গড়ে উঠেছে।” শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে যথাযোগ্য পদ্ধতি নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হয়। এই যথাযোগ্য পদ্ধতি নির্বাচন শিক্ষকের শিক্ষণ পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও নিজস্ব প্রক্রিয়া নির্ধারণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। অতএব শিক্ষককে সার্থক শিক্ষাদানের জন্য আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখতে হবে।
(৩) মনোবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ : দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য শিক্ষকের মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন। তিনি শিক্ষার্থীদের মানসিকতা সম্পর্কে যদি অবহিত না থাকেন, তবে তাদের পরিচালনা করা সেই শিক্ষকের পক্ষে অসুবিধাজনক। তাছাড়া সামাজিক মনোবিজ্ঞান সম্পর্কেও শিক্ষকের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
(৪) শিক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার : আধুনিক শিক্ষণপদ্ধতিতে শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার সর্ম্পকে জ্ঞান রাখা একান্ত প্রয়োজন। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির একটা বৈশিষ্ট্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষাদান। শিক্ষাদানের জন্য ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষার্থীকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। সুশিক্ষকের যেমন শ্রেণীকক্ষে প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করার মত মানসিক প্রস্তুতি থাকবে, তেমনি সেগুলোর প্রস্ততকরণ ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কেও ধারণা থাকা দরকার।
(৫) পরীক্ষামূলক মনোভাব : শিক্ষক যে শুধু গতানুগতিক শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করবেন তাই নয়, বিশেষ প্রয়োজন ও পরিস্থিতিতে শিক্ষাপদ্ধতিকে পরিবর্তন করাও তার কাজ। কারণ কোন পদ্ধতিই সব রকম পরিস্থিতির জন্য উপযোগী বা নির্দিষ্ট নয়। অনেক বিদ্যালয়ে বিশেষ বিশেষ শিক্ষণ ও আচরণমূলক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই সমস্যাকে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে সমাধান খুঁজে বের করার মত ক্ষমতা ও স্পৃহা একজন সুশিক্ষকের থাকা প্রয়োজন।
(৬) পরীক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাজের ধারা পরীক্ষা বা মূল্যায়নের পদ্ধতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পাঠের বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জ্ঞান পরিমাপের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা সম্পর্কে শিক্ষককে বিশেষ জ্ঞান রাখতে হয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কাজ – যেমন সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী, নৈর্ব্যক্তিক অভিক্ষা, সর্বাত্মক পরিচয়লিপি ইত্যাদি পরিমাপের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ও মূল্যায়নের ধারা বা পদ্ধতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবহিত হতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে শিক্ষণীয় সব কাজের যদি মূল্যায়ণ না করা হয়, তবে শিক্ষার্থী শুধু পাঠ্যবিষয় ছাড়া অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর উপর কোন গুরুত্বই দিবে না। যার ফলে তার সার্বিক বিকাশ কখনও সম্ভব হবে না।
(৭) সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী পরিচালনা : শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বেও পূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তিত্বেও সর্বাঙ্গীন বিকাশ শুধু মনের বিকাশের দ্বারা লাভ করা যায় না। মানসিক প্রক্রিয়া চর্চার সঙ্গে সঙ্গে এই সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের সহপাঠ্যক্রমিক কাজ কিভাবে পরিচালনা করতে হয়। এবং কিভাবে ঐগুলোকে শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা যায়; সে সম্পর্কেও একজন শিক্ষকের ধারনা থাকা প্রয়োজন।
গ: আচরণগত গুণাবলী:
শিক্ষাদান কার্যকে সফল করার জন্য শিক্ষককে কতগুলো আচরণগত গুণাবলীর অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাদানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। শিক্ষক যদি তার আচরণগত গুণাবলী দ্বারা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ না হন, তবে শিক্ষাদানে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হয়। অনেক শিক্ষক এই আচরণগত গুণের অভাবে শিক্ষকতায় সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হন না। একজন শিক্ষকের আচরণগত গুণাবলী নি¤œরুপ:
(১) প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার : শিক্ষক প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার দ্বারা সহজে ছাত্রদের মন জয় করতে পারেন। যে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি যতবেশি স্নেহপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল, সেই শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট ততবেশি প্রিয়। রুক্ষ অমার্জিত ব্যবহার ছাত্রদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
(২) পোশাক পরিচ্ছদ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা : শিক্ষরের পোষাক পরিচ্ছদ রুচিসম্মত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছনন্ন হওয়া প্রয়োজন। রুচিসম্মত পোষাক পরিচ্ছেদ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সহজেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনকে আকৃষ্ট করে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। আর এগুলোর প্রভাবও শিক্ষার্থীর মনের উপর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
(৩) সহানুভূতিশীল : শিক্ষককে সব সময় সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। কারণ শিক্ষাদানে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অনেক সময় সমস্যা ও অসুবিধার সৃষ্টি হয়। শিক্ষককে এগুলো সহানুভূতির সহিত বিবেচনা করতে হবে এবং শিক্ষার্থী যখন শিক্ষককে আপনজন বলে মনে করবে, তখন এই শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকের-আপনজনে পরিণত হবে। রুক্ষ এবং কঠোর ব্যবহার ছাত্রদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে।
(৪) শিক্ষাদানে আন্তরিকতা : শিক্ষাদান কার্যে আন্তরিকতা থাকাও শিক্ষকের জন্য একটি বড় গুন। কারণ কাজে আন্তরিকতা না থাকলে শিক্ষাদান কখনও ফলপ্রসূ হতে পারে না-দায় সারামত কাজ চালানো যায়। আন্তরিকতাই কাজে নিষ্ঠাবান করে তোলে।
(৫) সমালোচনামূলক বা ছিদ্রান্বেষী মনোভাব পরিহার : শিক্ষককে সব সময় ছিদ্রান্বেষী মনোভাব পরিহার করতে হবে। কারণ শিক্ষক যদি ছাত্র-ছাত্রীদের ভূলত্রুটিগুলো নিয়ে সব সময় সমালোচনায় তৎপর থাকেন বা ছাত্র-ছাত্রীদের দোষত্রুটি খুঁজে বের করার কাজে তৎপর থাকেন তবে ছাত্র-ছাত্রীরা সেই শিক্ষকের পাঠে কখনও মনোযোগ দিবেনা বরং তারা উক্ত শিক্ষকের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে।
এছাড়া আরও অনেক আচরণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দ্বারা সহজেই শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করা যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যৌথ সহযোগিতায় শিক্ষাদান ফলপ্রসূ হয়। অনেক সময় দেখা যায় প্রতিভাবান ও বহু গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ভাল শিক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করতে পারেন না। তার প্রধান কারণ এই পেশার প্রতি তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার একান্ত অভাব।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক
প্রাচীনকালের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রদের স্থান ছিল গৌণ-শিক্ষকই ছিলেন মূখ্য। শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষকের ইচ্ছামত পরিচালিত হত যেখানে শিক্ষার্থীর ক্ষমতা, প্রবণতা,আগ্রহ, ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম ছিল না বা এ সমস্ত বিষয়ে বিবেচনা করা হত না। আধুনিক কালের শিক্ষাব্যবস্থায় এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ছাত্র এবং তাকে ঘিরেই শিক্ষার সবকিছু আয়োজন। পূর্বে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন প্রকার সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। উভয়পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত না হলে সুষ্ঠু পাঠ পরিচালনায় বিঘœ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে শিক্ষকও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণমূলক প্রচেষ্টা চালাতে পারবেন না। তাছাড়া উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত না হলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় সম্পর্কে বিরূপ মতামত পোষণ করবে। এই সমস্ত কারণে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্কের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
শিক্ষক – শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা :
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্ম্পক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নি¤œরূপ:
প্রথমত : শিক্ষা ও শিক্ষণের ক্ষেত্রে এই সম্পর্কের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে না উঠে তাহলে এই শিক্ষা ও শিক্ষণের দ্বারা কোন পক্ষই উপকৃত হবে না। সুতরাং উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক শিক্ষা ও শিক্ষণ উভয় ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
দ্বিতীয়ত : আধুনিক শিক্ষাতত্ত্বে বিদ্যালয় ও সমাজ অভিন্ন। বিদ্যালয় হচ্ছে সমাজের প্রতিচ্ছবি। বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষর্থীর সামাজিক গুণাবলী বিকাশ সাধনে সহায়তা করা। সামাজিক গুণাবলী বিকাশ সাধনের জন্য সামাজিক পরিবেশের প্রয়োজন। সুতরাং বিদ্যালয়ে সামাজিক পরিবেশ রচনার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন।
তৃতীয়ত : আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যালয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। বিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থায় ছাত্রদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ দান করতে হবে। সুতরাং বিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে সংগঠিত করার কাজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উভয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন।
চতুর্থত : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীকে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান দেয়াহয়েছে। এই সহপাঠ্যক্রকিম কার্যাবলী অনুশীলন শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার একঘেয়েমী থেকে মুক্তি দেয় এবং সামাজিক গুণাবলী বিকাশে সহায়তা বন্ধুত্বসুলভ সর্ম্পক গড়ে তুলতে হয়। যে সমস্ত শিক্ষক এই কার্যাবলী পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তারা যদি ছাত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে এই কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কখনও সম্ভব হবে না।
পঞ্চমত : বিদ্যালয়ে-শৃঙ্খলা স্থাপনে ছাত্র-ছাত্রীদের যথেষ্ট ভুমিকা রয়েছে। আধুনিক শিক্ষাতত্ত্বে বলা হয়েছে, ছাত্ররা স্বত:স্ফুর্তভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আচরণ ধারার যে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই হচ্ছে শৃঙ্খলা। সুতরাং শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য শিক্ষকদের ছাত্রদের আচরণের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। শিক্ষক-শিক্ষাথী সর্ম্পক নিবিড় না হলে এই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কখনও সম্ভব হবে না।
সর্বশেষে : বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের প্রয়োজন, চাহিদা ও আর্থিক সাহায্য দ্বারা বিদ্যালয় পরিচালিত হয়। সমাজের আশা-আকাংখা বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যালয়ে আর্দশ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক এই পরিবেশ রচনায় সহায়তা করে।
ড. মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ খান
অধ্যক্ষ
তা‘মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা