বিশ্বে যত ভাষা আছে তন্মধ্যে আরবি ভাষার স্থান সর্বোচ্চ। এর সাথে তুলনা হতে পারে এমন কোন ভাষা অস্তিত্বহীন। স্বল্প শব্দসম্ভারে ব্যাপক অর্থসমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার কোন জুড়ি নেই। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষতা ও সমৃদ্ধি আধুনিক বিশ্বেও স্বীকৃত। মনে ভিন্ন ভিন্ন ভাব, সামান্য সামান্য পার্থক্য ও অবস্থার রূপ ও গুণ ইত্যাদি সঠিকরূপে পৃথক পৃথক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করার জন্যে আরবি ভাষার রূপ সর্বোর্ধ্বে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪ হাজার ভাষা প্রচলিত। এতে যে কয়টি ভাষা উচ্চ সাহিত্যের রূপ নিয়েছে আরবি এগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি প্রাচীন জীবন্ত ভাষা। যে কোন ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার একটি গুরুত্ব আছে। তবে আরবি ভাষা বিশেষত বিশ্ব মুসলিমের নিকট সর্বাধিক গুরুত্ব রাখে। এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আমি এ গ্রন্থকে আরবি কুরআনরূপে অবতীর্ণ করেছি। যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (ইউসুফ: ২)। এছাড়া পবিত্র কুরআনে আরো ইরাশাদ হয়েছে- ‘আমি এ কুরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে, আরবি ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে।’ (৩৯: ২৭-২৮)। স্বয়ং নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা আরবদেরকে (আরবি ভাষাকে) তিনটি কারণে ভালবাস, কেননা (১) আমি আরবি ভাষাভাষী, (২) কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এবং (৩) জান্নাতীদের ভাষা আরবি।’ (বায়হাকী)। অপর এক হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন রাসূল (স.) ফরমাইয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে আরবি ভাষায় কথা বলতে পারে সে যেন অনারবি ভাষায় কথা না বলে। কেননা, তা অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে। (ছালাফী) হযরত ওমর (রা.) বলেন, তোমরা হাদীসে জ্ঞান অর্জন কর এবং আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জন কর।’ অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তোমরা আরবি ভাষা শেখ, কেননা, এটি তোমাদের দ্বীনের অংশ। আল্লামা ইবন আল-আসীর বলেন, সর্বাপেক্ষা সম্মানিত গ্রন্থ সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূলের নিকট নাযিল হয়েছে।
আরবি ভাষায় রয়েছে স্থিতিস্থাপকতা ও গতিশীলতার এক বিস্ময়কর সমাহার। এ জন্য জনৈক কবি পবিত্র কুরআনের অনন্য সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
‘কি অপরূপ রূপের বাহার!
চোখ জুড়ানো রং যে ইহার
মন মাতানো সুরভি তাহার।
আরবি ভাষা একটি কালজয়ী, গতিশীল, বক্রতামুক্ত, সাবলীল ও মার্জিত ভাষা। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) এর ভাষা ছিল আরবি। আল্লামা জালালুদ্দীন সূয়ূতী (রহ.) তার ‘আল-ইতকান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: যার মূলকথা হল এই যে, সকল আসমানী গ্রন্থ ও সহীফা আরবি ভাষাই অবতীর্ণ হয়েছে। অত:পর নবীগণ তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় তার অনুবাদ করে তাদেরকে সেই গ্রন্থের বাণী ও শিক্ষা পৌঁছান। আসমানী গ্রন্থসমূহের কেবল পবিত্র কুরআনই তার মূলভাষা আরবিতে বহাল রয়েছে। আমি এভাষার গুরুত্ব বর্ণনায় তিনটি বিশেষ দিক তুলে ধরতে যাচ্ছি। (১) ভাষাগত দিক (২) বৈষয়িক দিক (৩) ধর্মীয় দিক। ভাষাগত দিক থেকে আরবি ভাষার কোন তুলনা হয় না। কেননা এর শব্দ এত ব্যাপক যে, কোন কোন শব্দ দু’শতেরও বেশি অর্থ বহন করে। আরবি ভাষার এক শব্দ অন্যান্য ভাষার তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এছাড়া এ ভাষার বিশেষ দিক হলো এর অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজন হয় নাহু, ছরফ এবং অলংকারশাস্ত্র ইত্যাদি। এ প্রত্যেকটি আবার বিশাল কলেবর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ভাষা হিসেবেঃ
অফুরন্ত শব্দসম্ভারঃ আরবি ভাষায় রেেছ অফুরন্ত শব্দসম্ভার। যা অন্যান্য ভাষাভাষিদের কাছে রীতিমত ঈর্ষার বিষয়। অপর পক্ষে আরবি ভাষার মধ্যে একই শব্দে নবতর অর্থের যেসব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয় অন্যান্য ভাষায় তা পরিলক্ষিত হয় না। একটি আরবি শব্দ থেকে অনেকগুলো নতুন শব্দ নির্গত হয় না। একটি আরবি শব্দ থেকে অনেকগুলো নতুন শব্দ নির্গত হয়। যার প্রত্যেকটি একটি বিশেষ অর্থ প্রদান করে। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় না। এ দৃষ্টিকোন থেকে আরবি ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা আরবি ভাষাকে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।
অধিক অর্থবহঃ হাজার হাজার ভাষার প্রাচুর্যে নুয়ে পড়া আমাদের এ পৃথিবী। কিন্তু এ হাজারও ভাষার মাঝেও নানা কারণে আরবি ভাষা শীর্ষে। যার অন্যতম কারণ হল আরবির মত এত অধিক অর্থসমৃদ্ধ ভাষা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। বিশেষ করে একটি শব্দের প্রায় দুশত অর্থ প্রদানকারী কোন ভাষা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেবল আরবি ভাষাই এক্ষেত্রে সফল।
অলংকারপূর্ণঃ পৃথিবীর কোন ভাষাই একদিনে পূর্ণতা লাভ করে না। নানা চড়াই উৎরাই আর ঘাত-প্রতিঘাত মাড়িয়ে একটি ভাষা সাবলীলতা লাভ করে। প্রায় সকল ভাষার ক্ষেত্রে একতা সত্য, কিন্তু আরবি ভাষার গতি-প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাঞ্জলতা লাভ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি এ ভাষাকে। সাহিত্যের মানদণ্ডে, সাবলিলতায়, রূপ সৌন্দর্যে বিশেষ করে অলঙ্করণে আরবি ভাষা পৃথিবীতে সেরা।
ব্যাকরণগতঃ আরবি ভাষার ব্যাকরণবিন্যাসও অতুলনীয়। যারা শৈল্পিকতার অনুপম দৃষ্টান্ত অন্য কোন ভাষাতে খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি ভাষার সমর্থনে নাহু, ছরফ, বালাগাত, ফাছাহাত ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিশাল কলেবরের ব্যাকরণ সংক্রান্ত পুস্তকাদি কেবল আরবির জন্যই রয়েছে। অন্য কোন ভাষার ক্ষেত্রে যা নজীরবিহীন।
স্থায়িত্ব ও উন্নতিঃ বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ভাষা হচ্ছে আরবি। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) আরবি ভাষার ধারক ও বাহক ছিলেন। সেই থেকে নিয়ে আজোবধি আরবি ভাষা শুধু টিকে আছে তাই নয়; কালের আবর্তনে সময়ের বিবর্তনে আরবি ভাষা দিনে দিনে নবযৌবন লাভ করেছে। বয়সের ভারে কখনও তা নুয়ে পড়েনি বরং আরও দ্বীপ্তিমান হয়েছে। আরবি ছাড়া অন্য কোন ভাষার ক্ষেত্রে এমন স্থায়িত্ব ও ক্রমোন্নতি সত্যিই অকল্পনীয়।
বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকেঃ
আন্তর্জাতিক ভাষাঃ বর্তমান বিশ্বে যতগুলো আন্তর্জাতিক ভাষা রয়েছে আরবি সেগুলোর অন্যতম। বরং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে আরবিই প্রধান। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রায় ২৪টি দেশের মানুষের মাতৃভাষা আরবি। বর্তমান বিশ্বের ৬২০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০ কোটি মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। আর যারা আরবি ভাষঅয় কথা বলতে পারেন না অথচ মুসলমান তারাও কুরআনের ভাষা আরবি পড়তে পারে। শুধু তাই নয় পুণ্যের আশায় গভীর মমতা ও ভালবাসা দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের আকর আল-কুরআন ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই কুরআনের লাখ লাখ হাফিজও রয়েছে যা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষাঃ আমরা পূর্বেই বলেছি পৃথিবীর মানচিত্রের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আরবি ভাষার অবস্থান। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, লেবানন, আরব আমিরাত, সিরিয়া, মিশরসহ আরও অনেক দেশ রয়েছে যাদের ভাষা আরবি। একই সাথে এই দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে খনিজ সম্পদের অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষি বহু দেশের নাগরিক আরবি ভাষার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে। উপরন্তু বিশ্ব বাণিজ্যের সবচেয়ে উর্বর ভূমি আরব দেশগুলোর সাথে সফল বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে আরবি ভাষাকে সমধিক গুরুত্ব দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
যোগাযোগের ভাষাঃ পৃথিবীর সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার হল আরবি, পৃথিবীতে সর্বাধিক অনুশীলিত ভাষার নাম আরবি। অতএব অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরবি অভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আরবি ভাষা বিশ্বের কোটি কোটি হৃদয়ের ভাষা হওয়ার কারণে এটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা গোটা মুসলিম বিশ্বের বাইরের জগৎ তথা গোটা বিশ্বজাহানকেও ভ্রাতৃত্বের অনুপম বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। ফলে আরবি ভাষা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অত্যুঞ্জল এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মূলত আরবি সকল সংকীর্ণতা ছিঁড়ে খুঁড়ে মুসলিম-অমুসলিম, আরব-আজম, কৃষ্ণাঙ্গ-শেতাঙ্গের সকল বিভেদ চুরমার করে দিয়ে একতার এক নতুন বিশ্ব গড়ার উদার সবক পৃথিবীবাসীর সামনে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। আমরা আল্লামা ইকবালের ভাষায় একসময় এমন সবকই শুনতে পেয়েছি- “চীন, আরব, হিন্দুস্তান তথা সারা বিশ্বই মুসলমানদের মাতৃভূমি।”
বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানভাণ্ডারঃ আধুনিক সভ্য বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতগুলো শাখা রয়েছে, তার প্রায় সবগুলো শাখাতে আরবি ভাষার অংশীদারিত্ব রয়েছে। শুধু অংশীদারিত্বই নয় বরং জ্ঞানের এসব শাখা অধিকাংশই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে, আর বাদ বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও এ ভাষার বিচরণ রয়েছে সমান তালে। বিশেষ করে ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন, গণিত, এলজেব্রা, তর্কশাস্ত্র, সামাজিক বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, ক্যালিওগ্রাফী, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে আরবি ভাষার গৌরবোজ্জল সফলতা সর্বজনবিদিত। সত্য বলতে কি জ্ঞানের এসব বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞান যা কিছু করছে তার অধিকাংশই আরবি ভাষা থেকে ধার করা। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই, আরবি ভাষা বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় রাতের আকাশের ধ্রুব নক্ষত্রের মতই দীপ্তিমান।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণঃ কেবল বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ বা সাহিত্যের মানদণ্ডে বিচার বিশ্লেষণে আরবি ভাষার মর্যাদা সীমাবদ্ধ নয়, বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
জান্নাতবাসীদের ভাষাঃ মুসলিম সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। বরং দুনিয়ার জীবনটা একটা পরীক্ষাগার মাত্র। ক্ষণকাল পরেই পরকালের দীর্ঘ জীবনে পাড়ি দিতে হবে সকলকে। সে জীবনে দুনিয়ার জীবনের সকল কর্মের হিসেব দিতে হবে। কর্মফল অনুযায়ী কেউ জাহান্নাম আর কেউ জান্নাতের অধিবাসী হবে। আর চিরসুখের চিরস্তায়ী নিবাস এ জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি। সুতরাং সঙ্গত কারণেই পরজগতে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আরবি ভাষা অতীব গুরুত্বের দাবীদার।
কুরআন ও হাদীসের ভাষাঃ আল কুরআনের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করে আমরাও বলতে চাই মানবতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পথনির্দেশক গ্রন্থ অবশ্যই আল-কুরআন। আর এই আল-কুরআনের ব্যাখ্যাই হল সুন্নাহ বা হাদীস। পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের চাবিকাঠি এই কুরআন এবং সুন্নাহর ভাষা হল আরবি। অতএব মানব সভ্যতার প্রকৃত যেহেতু আরবি ভাষায় প্রথিত সেহেতু এ ভাষার গুরুত্ব সীমাহীন সন্দেহ নেই।
ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডারের ভাষাঃ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারা হল কুরআনুল কারীম। বস্তুত পৃথিবীর সকল জ্ঞানের উৎস হল এই আল-কুরআন। শুধু তাই নয় বিজ্ঞানীগণ তাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীর স্থিরতা ও ঘূর্ণায়মান অবস্থা নিয়ে যখন টানাহেচড়ায় লিপ্ত ঠিক তখনই আরবি ভাষার আকর আল-কুরআন বলে দিল “সূর্যের এই ক্ষমতা নেই যে, সে চাঁদকে নাগালের মাঝে পাবে, না রাত দিনকে ডিংগিয়ে আগে চলে যেতে পারবে (মূলত চাঁদ সুরুজসহ) এরা প্রত্যেকেই শূন্যলোকে সাঁতার কেটে চলছে।” (সূরা ইয়াসি: ৪০) এ আয়াতে কারীমা দ্বারা বোঝা গেল যে মহাশূন্যের সবকিছুই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে। অথচ বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস বলেছিলেন সূর্য স্থির থাকে তার চারদিকে পৃথিবী ঘোরে আর গ্যালিলিও বললেন পৃথিবী স্থির থাকে আর সূর্য তার চারদিকে ঘোরে। এ দুটো ধারণাই ছিল মিথ্যা এবং কেবলই অনুমান নির্ভর। এ সকল মহাজাগতিক চিন্তা-চেতনা ছাড়াও ইসলামের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ, জীবনঘনিষ্ঠ শত শত বিখ্যাত সমাধানমূলক ফিকাহ গ্রন্থ, কুরআন হাদীসের অসংখ্য সংকলন, ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন ধরনের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ আরবি ভাষায় মুদ্রিত। সুতরাং ইসলামী জীবনদর্শনকে সঠিকভাবে জানতে হলে সেক্ষেত্রে আরবি ভাষার গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকার্য।
ইবাদতের ভাষাঃ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা যেটাই হোক না কেন তাদের সকলের ইবাদতরে ভাষা আরবি, সকলেই আরবি ভাষায় সালাত আদায় করে, আযান দেয়, একই ভাষায় খুতবা প্রদান করে। বিভিন্ন আদইয়ায়ে মাসনুনাহও সম্পন্ন হয় ঐ একই ভাষায়। সুতরাং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, আরবি ভাষা অত্যন্ত গুরুত্ববাহী।
সামাজিব জীবনে আরবি ভাষার প্রভাবঃ
আরবি ভাষা মানুষের কাছে সমাদৃতঃ বিশ্ব মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও কালজয়ী জীবন বিধান আল কুরআনের ভাষা আরবি, সকল নবী-রাসূলের উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থসমূহের ভাষা ছিল আরবি। পরকালের ভাষা আরবি, জান্নাতীদের ভাষা আরবি। এ যুগে বিশ্বায়নের উন্নত প্রযুক্তি, ব্যবসায় বাণিজ্য ও রাষ্ট্রনীতিতে একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে আরবি ভাষা। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সবটাই আরবি ভাষায় লিখিত অনুশীলিত। সুতরাং আরবি ভাষা সকল মানুষের কাছে সমাদৃত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যঃ আরবি ভাষার শব্দগঠন, বর্ণ প্রকরণ, স্থানান্তকরণ, রূপকার্থতা, ভাষাশৈলী, রূপমাধুর্য এ ভাষাকে সকলের কাছে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলনের পাশাপাশি এ ভাষা এরিস্টটলের অতিন্দ্রীয় দর্শনবিদ্যা, ইউক্লিডিসের সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহ ও গণিতশাস্ত্র, বুজরুয মেহেরের জ্ঞানগর্ব বিদ্যা, পারস্য সম্রাটের শাসনপ্রণালী ইত্যাদি আরবি ভাষায় চমৎকারভাবে রচিত ও মূল্যায়িত হয়েছে। সব মিলে আরবি পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ভাষা হয়েও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় অত্যন্ত সার্থক ও ফলপ্রসূ বিচরণ নিশ্চিত করতে পেরেছে। ফলে সর্বসাধারণের কাছে বর্তমানে আরবি অত্যধিক প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ভাষা।
অধিক মানুষের ব্যবহৃত ভাষাঃ পৃথিবীর সকল মানুষকে মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলতে হয়। কথা বলার জন্য কোন না কোন ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। এ ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি ভাষা অন্যতম। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আরবিতে কথা বলে। অর্থাৎ ৫০০ মিলিয়ন মানুষ তাদের পারিবারিক ও সামাজিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বহুমুখী সেক্টরে আরবি ভাষার ব্যবহার করে থাকেন। সুতরাং বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় আরবি অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাষা তদবিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
বহুগুণে গুণান্বিত আল-কুরআন ও হাদীসের ভাষা আরবির গুরুত্ব ও সমাজ জীবনে এর প্রভাব মূল্যায়ন ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন বাস্তবমুখী পরিকল্পনা। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চাই কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা। মুসলিম জাতি যদি স্বীয় আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, তবে নিজেদের অবহেলা পরিত্যাগ করে স্বীয় ভাষা আরবির প্রতি প্রত্যাবর্তন করা ছাড়া উপায় নেই। সে দিন কবে আসবে যেদিন সারা বিশ্বের মুসলমান জান্নাতী ভাষা আরবিকে জীবনের প্রতিটি স্তরে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। আমীন
ড. মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ খান
অধ্যক্ষ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা