
ভূমিকা (Preface) :
সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। দৈনন্দিন কাজকর্মের মাধ্যমে যেসব আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ও অভ্যাসের প্রকাশ পায় সে সবই হচ্ছে স্বভাব-চরিত্র। এ স্বভাব-চরিত্রের এমন কিছু রয়েছে যা নিকৃষ্ট ও অপছন্দনীয় যেমন- মিথ্যা, অহংকার, আত্মরম্ভিতা, সম্পদের লোভ গাফলতী, মূর্খতা, ফিসক, খিয়ানত ও নিফাক ইত্যাদি। সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে: The forbidden pattern of behav-ior, speech, dress, conduct, and manner brings hazards in the society. পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীতে যেভাবে সৎচরিত্রের অনেক মর্যাদা ও উপকারের কথা এসেছে তদ্রূপ মন্দ ও অসৎ চরিত্র এবং নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের অকল্যাণ ও ক্ষতির বিষয়েও মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। এ সব মন্দ ও অসৎ কর্মকাণ্ড থেকে মানুষ যখন মুক্ত থাকবে তখন সে হবে প্রকৃত মানুষ ও আদর্শ ব্যক্তি। তাঁদের উপর ভর করে সমাজে আসবে সুখ ও শান্তি। সমাজ হবে যুলুম ও নির্যাতন মুক্ত। যে সব অসৎ গুণাবলী বর্জন করা একান্ত প্রয়োজন, পবিত্র কুরান ও হাদীসের আলোকে বর্ণনা করা হল:
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত থাকা (To be indifferent in the rememberance of Allah)
আল্লাহ তা’আলার স্মরণ থেকে বিরত থাকা সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। পবিত্র কুরআনে এসেছে- যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এরূপ আমার নির্দেশনাবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং যেভাবে আজ তুমি বিস্মৃত হলে। (সূরা তাহা, ২০:১২৪-১২৬) অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান। তারপর সে হয় তার সহচর। (সূরা যুখরূফ, ৪৩-৩৬) রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এ প্রসঙ্গে বলেন- যে আল্লাহর স্মরণ করে এবং যে আল্লাহকে স্মরণ করে না এদের দৃষ্টান্ত হল জীবিত ও মৃতের ন্যায়।[1]
অহংকার ও দাম্ভিকতা Pride and audacity)
অহংকার ও দাম্ভিকতা হচ্ছে গুরুতর ব্যাধি। অহংকার অর্থাৎ নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জ্ঞান করা এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট মনে করা। দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে শয়তান। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে- আমি তার তথা আদম অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছো এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছো। (সূরা আ’রাফ, আয়াত ১২) তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির পর আল্লাহ তা’আলা বলেন, তুমি এই স্থান হতে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও। তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আ’রাফ, আয়াত-১৩) অহংকারের কুফল অনেক বেশি। অহংকারী ব্যক্তি যেহেতু নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে এ কারণে সে সাধারণ মানুষের সাথে উঠা-বসা, পানাহার ও কথাবার্তা বলাকে নিজেকে মর্যাদার খেলাপ মনে করে। যখন সে মানুষের সাথে মিলিত হয় তখন কামনা করে যে, মানুষ তাকে সম্মান করুক। এ কারনে আল্লাহ তা’আলা দাম্ভিক ও অহংকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। পবিত্র কুরআনে এসেছে- আল্লাহ কোন উদ্ধত-অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা লুকমান, ৩১:১৮) হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, বড়ত্ব আমার চাদর এবং মহানত্ত্ব আমার ইযার। কেউ যদি এ দু’টির কোন একটির ব্যাপারে আমার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় তবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।[2] অহংকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যার অন্তরে এক যাররা তথা অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[3] অহংকার ও দাম্ভিকতার কারণসমূহ অনেক। তবে সাধারণভাবে মানুষ বংশ-কুল, রূপ-সৌন্দর্য, মাল-দৌলত, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য, বন্ধু-বান্ধব ও সাহায্যকারীর আধিক্যের কারণে অহংকার করে থাকে। ইসলাম এগুলোর অপকারিতা ও অকল্যাণের কথা তুলে ধরে এ কথা প্রমাণ করেছে যে, এসবের কোনটি অহংকার ও গর্বের হতে পারে না। কাজেই অহংকার ও দাম্ভিকতা বর্জন করে বিনয় ও নম্রতা Aej¤^b করা অপরিহার্য।
মিথ্যাচার (Falsehood)
কথা-বার্তা ও কাজকর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা হারাম তথা নিষেধ। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা গুরুতর অপরাধ। কোন ধর্মেই মিথ্যাকে অনুমোদন করে না। পবিত্র কুরআনে এসেছে ‘তোমরা মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাক’ (সূরা আল-হাজ্জ, ২২:৩০) মিথ্যা মানুষকে কঠিন শাস্তির স্থান জাহান্নামে পৌঁছিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) বলেছেন- “তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কেননা মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়, আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। ব্যক্তি যখন অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে তখন আল্লাহর নিকট তাকে মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়”।[4]
মিথ্যা কথা বলা মুনাফেকীর নিদর্শনও বটে। হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুনাফিকের আলামত ৩টি এর মধ্যে একটি হল, যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে।[5] অঙ্গীকার ভঙ্গ করাও এক প্রকারের মিথ্যা। মু’মিনের জন্য উচিত অঙ্গীকার রক্ষা করা। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অঙ্গীকার ভঙ্গ করকে মুনাফেকীর নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। কোন কথা শুনার পর তা যাচাই না করে বলতে থাকা মানুষকে এক পর্যায়ে মিথ্যা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।[6]
সম্মান ও সম্পদের লোভ (Greediness for honour and wealth)
মানুষের মাঝে এমন আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা করা বা এরূপ আকাঙক্ষা করা যে, সকলের মন যেন আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়, সকলে যেন আমার প্রশংসা করে। মান-সম্মানের লিপ্সা ব্যক্তির দীন-দুনিয়া উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এ কারণেই রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ চেড়ে দিলে যে রকম ক্ষতির আশংকা থাকে সম্মান লিপ্সা ও সম্পদের মোহ মানুষের দীনের জন্য তার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর’।[7]
বস্তুত সম্মান অতিমোহ নিতান্তই ক্ষতিকর। এর কারণে মানবতার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষসহ নানা প্রকার বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এতে পরস্পরেরমধ্যে হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এমন কি পর্যায়ক্রমে তা খুন-খারাবির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্পদের লোভ-লালসাও একটি গুরুতর ব্যাধি। বিশেষ ভাবে লোভ-লালসার সাথে যদি কৃপণতার ছোঁয়াও থাকে তাহলে তা হবে অধিকতর নিকৃষ্ট। লোভী হওয়ার অর্থ এই নয় যে, সে তার ধন-সম্পদ খরচ করে না। বরং এর অর্থ হল, সে অন্যেল ধন-সম্পদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার চেষ্টা করে। ইসলাম এরূপ লোভকে নিষিদ্ধ করেছে। এর দুটি ক্ষতিকর দিক রয়েছে: ১. একটি হচ্ছে কৃপণতা, ২. আর অপরটি হচ্ছে হিংসা। পবিত্র কুরআনে এসেছে- যার দ্বারা আল্লাহ পাক তোমাদের কাউকে অপর কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা করো না। (সূলা নিসা, ৪:৩২) চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং খুন-খারাবিসহ অধিকাংশ বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উস্কিয়ে দিয়েছে। আর এ লোভ-লালসার কারনেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।[8]
রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোভ-লালসাকে সর্বদা দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঈমান এবং লোভ এক অন্তরে একত্রিত হতে পারে না।” এর কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। কেননা ঈমানের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, তায়াক্কুল এবং অল্পে তুষ্ট থাকা ইত্যাদি। আর লোভ-লালসার পরিণাম হচ্ছে অশান্তি, ধৈর্যহীনতা এবং অস্বস্তিবোধ।[9] তিনি আরো বলেন, মানুষ বার্ধক্যে উপনীত হয় কিন্তু দুটি জিনিস তার মধ্যে যৌবনপ্রাপ্ত (প্রবল) হতে থাকে:
১. দুনিয়ার মহব্বত, ২. অধিক পাওয়ার আকাঙক্ষা।[10]
অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- এই উম্মাতের প্রথম সফলতা আসছে ইয়াকীন ও যুহদ তথা নিরাসক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর তাদের প্রথম ধ্বংস আসছে কৃপণতা ও লোভের মধ্যে দিয়ে।[11]
দুনিয়ার প্রতি অধিক ভালবাসা (Deep addiction to the Worldliness)
দুনিয়া কেবল সম্পদ ও সম্মানের প্রতি অনুরাগকেই বলা হয় না। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের জীবনের যত অবস্থা আছে, সবই দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত। দুনিয়ার মায়াই সমস্ত কর্মের মূল। দুনিয়ার কাজ-কারবার, স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব, ধন-সম্পদ ইত্যাদি যে কোন বস্তুর সাথে অন্তরাত্মাকে আবদ্ধ করার নামই হচ্ছে হুব্বে দুনিয়া বা দুনিয়ার ভালবাসা। দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের সম্বল সংগ্রহ করার জায়গা। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।[12] দুনিয়া মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করার স্থান। এটা মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য নয়। বরং মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল আখিরাত। এতদসত্ত্বেও মানুষ দুনিয়ার লোভে পড়ে এমনভাবে আত্মহারা হয়ে যায় যে, সে কোথা থেকে এসেছে এবং তার গন্তব্য স্থান কোথায়? এ ব্যাপারে সে উদাসীন থাকে। এ ভাবে যারা পার্থিব বিসয়াদিতে নিমজ্জিত হয়ে যায় তাদেরকে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসেছে- তোমরা জেনে রেখ, পার্থিব জীবনে তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গর্বপ্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উপমা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য ভান্ডার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। (সূরা হাদীদ, ৫৭:২০। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন- এবং আখিরাতের জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানতো। (সূরা আনকাবুত, ২৯:৬৪) আখিরাত বিস্মৃত ও দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত লোকদেরকে সতর্ক করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘সাবধান! দুনিয়া অভিশপ্ত তবে আল্লাহর যিকর প্রিয় আমল, আলিম এবং মুতা’আল্লিম তথা জ্ঞানী ও জ্ঞানঅন্বেষণণকারী ব্যতীত পৃথিবীতে যত কিছু আছে সবই অভিশপ্ত।[13] দুনিয়া ও আখিরাত পরস্পর সতীনের মত। একটিকে মহব্বত করলে অপরটি স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যে ব্যক্তি দুনিয়াকে অধিক ভালবাসল সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালবাসল সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। সুতরাং তোমরা অস্থায়ী বস্তুর উপর চিরস্থায়ী বস্তুকে প্রাধান্য দিবে।[14] তিনি আরো বলেছেন, দুনিয়া পেছনের দিক চলে যাচ্ছে। আর আখিরাত সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। এ দু’টির প্রত্যেকটির রয়েছে আসক্তবৃন্দ। সুতরাং তোমরা আখিরাতের আসক্ত হয়ে থেকো। দুনিয়ার আসক্ত হয়ো না। কারণ দুনিয়া কজের সময় কিন্তু হিসাব নেই। আর আগামীকাল তথা পরকাল হবে হিসাবের, সেখানে কাজ করার সুযোগ নেই।[15] দুনিয়া লিপ্সার অকল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত করে নবী (সা.) বলেন: দীনার ও দিরহামের
গোলামবৃন্দ ধ্বংস হোক। তাদেরকে এসব কিছু দেওয়া হলে তারা সন্তুষ্ট থাকে। আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়।[16] দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন।
কৃপণতা (Miserliness)
কৃপণতা একটি মন্দ স্বভাব। খিয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্দয়তা ইত্যাদি মন্দ ¯^fve থেকে এর সৃষ্টি হয়। ইসলাম কৃপণতার মূলোৎপাটনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ কারণেই ধার্তকে খাদ্যদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অভাবগ্রস্তকে সাহায্যদান, ইয়াতীমদের লালন-পালন ও ঋণগ্রস্তদেরকে সাহায্যদান মুসলমানদের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে এ সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন বলে হযরত খাদীজা (রা.) উক্তি থেকে জানা যায়। তিনি বলেন- ‘আপনি আত্মীয়েল প্রতি সদাচার করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির জন্য উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহায়তা দান করেন।’[17]
কৃপণতা মানুষের জন্য কখনো কল্যাণকর নয়। বরং তা অনিষ্টই বয়ে আনে। পবিত্র কুরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তাদের জন্য তা মঙ্গল এটা যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে বিষয়ে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন তা তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে। (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৮০। কৃপণতা মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। ইরশাদ হয়েছে- তোমাদেরকে কিসে সাকার (জাহান্নামে) এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলেন, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না এবং আমরা অভাবগ্রস্তদের আহার্য দান করতাম না। (সূরা মুদ্দাসসির, ৭৫:৪২-৪৪) রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর থেকে দূরে জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী থাকবে।’[18]
কৃপণের পরিণাম সম্পর্কে নবী করীম (সা.) বলেন- প্রতারক, কৃপণ এবং যে ব্যক্তি নিজ অনুগ্রহের কথা বলে বেড়ায় তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[19] তিনি আরো বলেন, ‘কৃপণতা ও মন্দ স্বভাব মু’মিন ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হতে পরে না।’[20] রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা এ কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদেরকে উসকিয়ে দিয়েছে যেন তারা রক্তপাত ঘটায় এবং হারামকে হালাল জানে।’[21]
অপব্যয় ও অপচয় (Unfrugality and Wasting)
ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতা যেমনিভাবে দোষণীয় অনুরূপভাবে অপব্যয় এবং অপচয় দোষণীয়। ‘ইসরাফ’ অর্থ সীমা অতিক্রম করা। শরী’আতের পরিভাষায়, বৈধকাজে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করাকে ‘ইসরাফ’ বা অপচয় বলে। কুরআন মাজীদে আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়’। (সূরা ফুরকান, ২৫:৬৭) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপব্যয় করবে না। তিনি অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ, ৭:৩১) আর অবৈধ কাজে ব্যয় করাকে ‘তাবযীর’ বা অপব্যয় বলে। ইসলামে এটিও নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে এসেছে- আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭:২৬-২৭) আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে হলে অপব্যয় ও অপচয় পরিহার করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যে ব্যক্তি ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে সে কখনো ফকীর ও অভাবগ্রস্ত হয় না।[22]
ক্রোধ ও রাগ (Anger)
ক্রোধ ও রাগের বলগাহীন ব্যবহার বহু অনিষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কর্মকান্ড মানুষ ক্রোধ ও রাগের কারণে করে ফেলে। কিন্তু পরবর্তীতে এর কারণে অনেক ক্ষেত্রে লজ্জিত ও অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হতে হয়। তাই মুসলমানের জন্য উচিত ক্রোধের সময় নিজেকে স্মরণ করা এবং অকারণে রাগ ও ক্রোধ প্রকাশ না করা। আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকী লোকদের প্রশংসা করে বলেন- এবং যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়। (সূরা শূরা, ৪২:৩৭) স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে ক্ষমা করে দেওয়া তো সহজ ব্যাপার। কিন্তু রাগের সময় ক্ষমা করা তেমন সহজ বিষয় নয়। তারপরও একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল এ অবস্থায়ও নিজেকে সম্বরণ করা। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ঐ ব্যক্তি বীর পুরুষ নয় যে অন্যকে ধরাশায়ী করে। বরং সেই প্রকৃত বীর যে রাগের সময় নিজেকে সম্বরণ করতে পারে।[23]
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাকে অসিয়্যাত করুন, তিনি বললেন, রাগ করবে না। লোকটি বারবার তার কথাটি বলতে থাকলে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও একই জবাব দিলেন এবং বললেন রাগ করবে না।[24] তিনি আরো বললেন, রাগ-গোস্বা শয়তানের তরফ থেকে আসে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠান্ডা করে। যদি কারো রাগ-গোস্বা হয় তবে তার উচিত অযু করে নেওয়া।[25] ‘হযরত আবু যর গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যদি দাঁড়ানো অবস্থায় কারো রাগ-গোস্বা হয় তবে সে যেন বসে যায়। এতেও যদি তার প্রশমিত না হয় তবে সে যেন শুয়ে পড়ে।[26] অকারণে রাগ করাতে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। নবী করীম (সা.) বলেন- রাগ-গোস্বা মানুষের ঈমানকে নষ্ট করে দেয় যেমনিভাবে তিক্ত ফল মধুকে নষ্ট করে দেয়।[27]
হিংসা–বিদ্বেষ (Jealousness)
হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্যের সুখ-সম্পদ নষ্ট করে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা করাকে হাসাদ বলা হয়। অপরের প্রতি হিংসা করা হারাম। হিংসার বহু কারণ রয়েছে। যেমন: শত্রুতা, অহংকার, নিজের অসদুদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্বের লোভ, কাঙিক্ষত অনুগত লোকদের যোগ্যতাবান হয়ে যাওয়া এবং কোন সুযোগ-সুবিধা হাসিল হওয়া, ব্যক্তি বা খান্দানী-নীচুতা বা কার্পণ্য ইত্যাদি। এসব কারণে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি প্রতি হিংসা করে থাকে। ইসলামী শরী’আতে এগুলো সবই নিষিদ্ধ। হিংসার অনিষ্টকারিতার কথা উল্লেখ পূর্বক রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তোমরা হিংসা থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা হিংসা নেক আমলকে খেয়ে ফেলে যেমনিভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।[28] তিনি আরো বলেন- তোমরা অন্যের প্রতি মন্দধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা এরূপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারো দোষ-অনুসন্ধান করো না, কারো গোপনীয় বিষয় তালাশ করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিবে না, আর পরস্পর হিংসা করবে না, একে অপরের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করবে না এবং পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থাকবে।[29] আল্লাহ তা’আলা হিংসা থেকে পানাহ চাওয়ার জন্য পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে- এবং হিংসকুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই যখন সে হিংসা করে। (সূরা ফালাক, ১১৩:৫)
অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করারও বদ-অভ্যাসের মধ্যে শামিল। কোন কারণে কারো প্রতি দুশমনির ভাব দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধরে রাখার নাম বিদ্বেষ। অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হারাম। হাদীসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘প্রতি জুমুআ তথা সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলসমূহ পেশ করা হয় এবং সমস্ত মুমিন বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনী আছে তাদেরকে ক্ষমা করা হয় না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন তাদেরকে ছেড়ে দাও, যেন তারা ফিরে আসে, অর্থাৎ মিলে যায়।[30] তিনি আরো বলেন, ‘তিন ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয় না। তন্মধ্যে একজন হচ্ছে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি।’[31]
আত্মগৌরব Self pride)
আত্মগৌরব অর্থাৎ নিজেকে নিজে ভাল মনে করা এটাও অহংকারেরই একটি শাখা। তবে অহংকার ও আত্মগৌরবের মধ্যে পার্থক্য অন্যের তুলনায় নিজেকে বড় মনে করাকে অহংকার বলে। আর অন্যের দিকে লক্ষ্য না করে কেবল নিজেকে মহতি গুণের মালিক বলে ধারণা করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীকে নিজস্ব সম্পদ মনে করতঃ তা হস্তচ্যুত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ ভয় না করাকে আত্মগৌরব বলে। তাসাওউফের ভাষায় একে ‘উজব’ বলা হয়। আত্মগৌরবের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসেছে- প্রবৃত্তির অনুগামী হওয়া, কৃপণতার অনুগত হওয়া এবং আত্মপ্রশংসায় লিপ্ত হওয়া, এগুলো হচ্ছে ধ্বংসাত্মক বদ অভ্যাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত। তবে এ সবের মধ্যে শেষোক্তটি হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্য।[32]
নিজেকে পছন্দ করা, নিজের রায়কে বিজ্ঞতম মনে করা এবং অন্যের মতামতের প্রতি কোন গুরুত্ব প্রদান না করাতে বিভিন্ন ধরণের অকল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ ধরণের মন-মানসিকতার কারণেই পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ, মারামারি ইত্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে। কাজেই নিজের কাজ ও রায়কে নির্ভুল না ভেবে অন্যের রায়ের প্রতিও গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।
অশ্লীল কথাবার্তা (Illicit Speech)
কাম-প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে মানুষ অশ্লীল কথা বলে। আবার ক্রোধের বশীভ্থত হয়েও লোকেরা এ ধরণের কথাবার্তা বলে থাকে। কোন অবস্থাতেই অশ্লীল কথাবার্তা ও গালিগালাজ করা উচিৎ নয়। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কোন মুসলমানকে গালি দেওয়া ফিসক এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী।[33] তিনি আরো বলেন- প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কারো প্রতি ভর্ৎসনা ও লা’নত করে না সে কোন অশালীন এবং অশ্লীল কথাও বলে না।[34] হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গালিগালাজকারী, অশালীন এবং অভিশম্পাতকারী ছিলেন না। আমাদের কারো উপর তিনি নারাজ হলে কেবল এতটুকু বলতেন যে, তার কি হল! তার কপাল ধুলাময় হোক।[35] তিনি আরো বলেন, তুমি রূঢ়-ব্যবহার এবং অশালীন আচরণ বা কথা বর্জন করবে।[36] ইসলামী শরীআতে গালিগালাজ, অশালীন ও অশ্লীল কথাবার্তা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হল, গালিগালাজের সময় সীমালংঘন হয়ে যায়। একজনে যদি কারো বাপকে গালি দেয় তবে অপরজন তার বাবা-মা সহ সকলকে গালি দেয়। এভাবে সীমালংঘন হয়ে পরে মারামারির উপক্রম হয়ে যায়। অশালীন ও অশ্লীল কথা বলতে যারা অভ্যস্ত লোকেরা তাদেরকে ঘৃণা করে। কেউ তাদের সাথে মেলামেশা করতে চায় না। গালমন্দ করা অভদ্রতা ও সভ্যতার পরিপন্থী কাজ। অধিকন্ত এতে অন্য মানুষের কষ্ট হয়। কোন মুসলমানকে এমনকি কোন মানুষকে কষ্ট দেওয়াও নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- প্রকৃত মুসলমান সেই, যার কথা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।[37] অপর এক বর্ণনায় ‘অন্য মুসলমান’ এর স্থানে ‘অন্য মানুষ’ বর্ণিত হয়েছে। কাজেই অশালীন ও অশ্লীল কথাবার্তা বলে কাউকে কষ্ট দেওয়া সম্পূর্ণরূপে অনুচিত।
ধোঁকা ও প্রতারণা (Fraud)
লেন-দেন ও বেচা-কেনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রতারণা করা পণ্যদ্রব্যের পরিচয় দান কিংবা বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুল প্রচারণা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন খাদ্যবস্তুর স্তুপের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় এর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে এর অভ্যন্তরে সিক্ত পেলেন। তখন তিনি বললৈন, হে খাদ্য মালিক! এটি কি? জবাবে সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! বৃষ্টির কারণে এরূপ হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি বললেন- তুমি ভিজা খাদ্যশস্য উপরে রাখলে না কেন? তাহলে তো ক্রেতাগণ এর অবস্থা দেখতে পেত প্রতারিত হত না। যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মাতের মধ্যে গণ্য হবে না।[38] ধোঁকা ও প্রতারণা হীন মানসিকতার পরিচায়ক। এর মাধ্যমে অপরকে ঠকানো হয় এবং মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়, বিধায় ইসলামী শরীআতে ধোঁকা ও প্রতারণা হারাম।
খোশামোদ, তোষামোদ ও অতিশয় প্রশংসা (Snobbing and extra-praising)
খোশামোদ, তোষামোদ এবং কারো প্রশংসায় অতিশয় উক্তি করা নীচুতা ও লজ্জাহীনতার আলামত। সাথে সাথে মিথ্যার একটি প্রচ্ছন্ন রূপও এতে লুক্কায়িত থাকে। যারা এভাবে অন্যের খোশামোদ করে এবং অভ্যস্ত ¯^fv‡e অপরের প্রশংসা করে তারা একই সাথে তিন ধরণের গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাকে:
১. খোশামোদকারী লোকেরা নিজের মতলব হাসিলের জন্য এমন সব প্রশংসা করে যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা নির্লজ্জ মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়।
২. প্রশংসাকারী ব্যক্তি নিজের মুখ দ্বারা এমন প্রশংসাসূচক বাক্যাবলী উচ্চারণ করে যার পতি সে নিজেও বিশ্বাসী নয়। এ ধরণের কথা মুনাফিকী বৈকি:
৩. এভাবে প্রশংসা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করে। এতে তার নীচুতা, নির্লজ্জতা ও হঠকারিতা প্রকাশ যায়।
এ ধরণের প্রশংসা করার কারণে প্রশংসিত ব্যক্তির দুই ধরণের ক্ষতি হয়ে থাকে: প্রথমত, সে অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, দ্বিতীয়ত, সে এই মিথ্যা প্রশংসা শ্রবণ করে নিজের সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করে এবং অন্যান্য লোকদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের নজরে দেখতে থাকে। আর সর্বক্ষণ সমস্ত মানুষের পক্ষ হতে এ জাতীয় প্রশংসা বাণী শুনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। পরিণামে তাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, কৃতকর্মের উপরও প্রশংসিত হতে চায়। এ ধরণের নির্লজ্জ কামনাকারী লোকদের পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে- যারা নিজেরা যা করেছে তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যা নিজেরা করেনি এমন কার্যের জন্য ও প্রশংসিত হতে ভালবাসে, তারা শাস্তি হতে মুক্তি পাবে, এরূপ তুমি কখনো মনে করবে না। তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে (সূরা আলে ইমরান, আ: ১৮৮)
কোন মতলব হাসিলের জন্য অবাস্তব ও মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা অন্যায়। এহেন প্রশংসা যা উক্ত ব্যক্তির নিজের জন্যও ক্ষতিকর। এ প্রসঙ্গে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবু মূসা (রা.) বলেন, একদা নবী করীম (সা.) একজনকে আরেকজনের অতিরঞ্জিত প্রশংসা করতে শুনে বললেন, তোমরা তো লোকটিকে মের ফেললে অথবা বললেন, লোকটির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিলে।[39] যদি কারো প্রশংসা করতেই হয় বলবে, তার সম্পর্কে আমার ধারণা এরূপ।[40] মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হলে প্রশংসিত ব্যক্তি অহংকারী হয়ে যাবে, তার জীবনের গতি থেমে যাবে এবং তার নিজের দোষ আর তখন তার নযরে পড়বে না। এ কারণে মুখের উপর প্রশংসাকারী ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা যদি কাউকে মাত্রারিক্ত প্রশংসা করতে দেখ তাহলে তাদের মুখে মাটি ছুঁড়ে মারবে।[41] কোন ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা করা আরো জঘন্য অপরাধ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কোন ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা করা হলে আল্লাহ তা’আলা ক্রোধান্বিত হন এবং এতে তার আরশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে।[42] দ্বিমুখী নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি, যে এক ব্যক্তির নিকট তার প্রশংসা করে, অন্যত্র গিয়ে আবার তার বদনাম করে এবং সম্মুখস্ত ব্যক্তির প্রশংসা করে তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘দুনিয়ার জীবনে যে ব্যক্তি দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করবে কিয়ামতের দিন তার মুখে একটি আগুনের জিহ্বা লাগিয়ে দেওয়া হবে।’[43]
উপসংহার (Conclusion)
বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তি পরিবার সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের কালো থাবা নেমে এসেছে। সকলেই এ মহাদুর্যোগ ও ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু মুক্তির পথ খুঁজে মানুষ দিশেহারা। মূলত মুক্তির জন্য প্রয়োজন একদল আদর্শ মানব যারা হবে একাধারে নিষ্ঠাবান, সত্যবাদী, আমানতদার, ন্যঅয় পরায়ণ, বিশ্বস্ত ও অঙ্গীকারকারী, কর্মঠ, দায়িত্বপরায়ণ, সত্য প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ নির্লোভ প্রান্তরে তারা মুক্ত ও থাকবে মিথ্যাচার, অহংকার, কৃপণতা, গীবত, অপব্যয়-অপচয়, প্রতারণা, ক্রোধ ও রাগ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ লালসা, আত্মম্ভরিতা ও আত্মগৌরব অশ্লীল কাথাবার্তা, ধোঁকা ও প্রতারণা, খোশামোদ-তোষামোদ ও অতিপ্রশংসার মত জঘন্য মন্দস্বভাব থেকে। একটি সুন্দর, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধশালী কল্যাণকর সুখী সমাজ বিনির্মাণে এ ধরণের ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভর করে। অশান্ত এ পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন জীবনের সকল ক্ষেত্রে থেকে মন্দ স্বভাবসমূহ বর্জন করা। এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশিত পথে চলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণকর কাজ করার তৌফিক দান করুন।
dr_abuyusuf@yahoo.com
১. বুখারী সহীহ, আসাহহুল মাতাবে’ ইন্ডিয়া-১৯৮৫, কিতাবুল দাওয়াত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৪৮।
২. মুসলিম সহীহ, আল-মাকাতাবুল আশরাফিয়া দেওবন্দ।
৩. মুসলিম সহীহ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান, পৃ. ১০।|
৫. বুখারী সহীহ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান, পৃ. ১০।
৬. মুসলিম সহীহ, মুকাদ্দামা, পৃ. ০৮।
৭. তিরমিযী ও দারিমী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৪১।
৮. মুসলিম সহীহ, সুত্র: সীরাতুন্নবী (সা.) ৬ষ্ঠ খণ্ড , পৃ. ৩২৫
১০. বুখারী সহীহ ২য় খণ্ড, কিতাবুল রিকাক, পৃ. ৯৫০।
১১. বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৫০।
১২. আল-মুরশিদুল আমীন: ইমাম গাজালী (রহ.) (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ২০৯।
১৩. তিরমিযী, মাকতাবুল আশরাফিয়া দেওবন্দ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৮।
১৪. আহমাদ ও বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৪১।
১৫. বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল রিকাক, পৃ. ৯৫০।
১৬ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল রিকাক, পৃ. ৯৫২।
১৭ বুখারী সহীহ, ১ম খণ্ড, বাদউল ওহী, পৃ. ৩।
১৮ তিরমিযী, ২য় খণ্ড পৃ. ১৭।
১৯ তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮-।
২০ তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮-।
২১ তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮।
২২ তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন, পৃ. ৯৭০।
২৩ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদব, পৃ. ৯০৩।
২৪ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদব, পৃ. ৯০৩।
২৫ আবু দাউদ, সুত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৪৪।
২৬ আহমাদ ও তিরমিযী, সুত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৪৪।
২৭ বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৪৪।
২৮ আবু দাউদ, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪২৮।
২৯ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদব, পৃ ৮৯৬।
৩০ মুসলিম সহী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪২৮।
৩১ আল আদাবুল মুফারাদ, ইমাম বুখারী (রা.)।
৩২ বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪৩৪।
৩৩ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯৩।
৩৪ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯৩।
৩৫ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯১।
৩৬ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯১।
৩৭ বুখারী সহীহ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান, পৃ. ০৬।
৩৮ মুসলিম, সূত্র, মিশকাত, পৃ. ২৪৮।
৩৯ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯৫।
৪০ বুখারী সহীহ, ২য় খণ্ড, কিতাবুল আদাব, পৃ. ৮৯৫।
৪১ তিরমিযী- ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৫।
৪২ বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ. ৪১৪।
৪৩ দারিমী, সূত্র: মিশকাত, ৪১৩।